তৌহিদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত। সমাজ ও সমাজস্থ বিষয় তাঁর গবেষণার মূল আরাধ্য। অল্প সময়ে খ্যাতি পেয়েছেন অপরাধ, ভিকটিমোলজি ও রেস্টোরেটিভ জাস্টিস বিষয়ে বিশ্লেষণ, গবেষণা ও সম্পাদনায়। তাঁর অঙ্গনে তিনি সফল একজন মানুষ। সমাজকল্যাণ বিষয়ে ক্যারিয়ার নিয়ে তাঁর সাথে আলাপ করেছেন- আমির সোহেল।
ক্যারিয়ার : উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসেবে সমাজকল্যাণের গুরুত্ব সম্পর্কে বলুন।
তৌহিদুল হক : বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সমাজকল্যাণ শিক্ষার গুরুত্ব সময়ের প্রয়োজনে যেমন সৃষ্ট তেমনি সময়ের সাথে সাথে এর প্রয়োজনীয়তা ক্রম-প্রসারমান। মূলত অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশ্বকে পরিবর্তনের চেতনায় সৃষ্ট সমস্যার কার্যকরী নিয়ন্ত্রণমূলক সমাধান প্রক্রিয়াকে অগ্রগামী করার একাডেমিক যাত্রায় সমাজকল্যাণের দ্রুত প্রক্রিয়াগত ব্যবহার শুরু হয়েছে; যা বর্তমানে সমাজ উন্নয়নের মূল প্রক্রিয়া ও সেবা প্রদানের পেশাগত আদলে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে সমাজকল্যাণ শিক্ষার গুরুত্ব মানে সময়কে গুরুত্ব দেয়া, সমাজকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা। কারণ বৈশ্বিক ও দেশীয় সমাজ পরিবর্তনের ধারায় সমাজকল্যাণের শিক্ষা স্বপ্ন দেখায় সমস্যামুক্ত মানসম্পন্ন মানুষের যারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে নেতৃত্ব দিবে সমন্বিত উন্নয়নের কারিগর/উদ্যোক্তা হিসেবে।
ক্যারিয়ার : সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিষয় হিসেবে সমাজকল্যাণের প্রয়োজনীয়তা কী?
তৌহিদুল হক : সমাজকল্যাণ সমাজসেবামূলক প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার প্রদান করে এবং সমাজের বিদ্যমান অসঙ্গতিপূর্ণ অবস্থাকে পরিবর্তন করে সমাজ কাঠামো তথা মানুষে-মানুষে সমাজের গতিবিধি নিত্যরূপে প্রণয়নে সহায়ক ভূমিকা নির্ণয়ে পেশাগত মর্যাদায় মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কর্ম-কৌশল নির্ধারণ করে। সমাজবদলের পেশাগত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মর্যাদায় সমাজকল্যাণ সামাজিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা হিসেবে এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার সামাজিক প্রপঞ্চগুলোকে সামাজিক মর্যাদায় আনয়নে সমাজকল্যাণের প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। প্রথমত ‘পরিবর্তন ও সেবা’ সমাজকল্যাণের মূল দার্শনিক ভিত্তি যা সমাজের সদস্যকে নতুন করে আহ্বান জানায় সমাজসেবায় নিয়োজিত হতে। কারণ উন্নয়নের সামগ্রিক চিন্তায় সঠিক প্রেক্ষাপটে বিবেচ্য যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের একার পক্ষে সকল জনচাহিদা পূরণ অসম্ভব। এমতাবস্থায়, সমাজের সমগ্র মানবীয় সম্পদের সর্বোচ্চ একত্রীকরণের লক্ষ্যে সমাজকল্যাণের প্রয়োগ সত্যি-সত্যি পরিবর্তন আনতে সক্ষম; যে পরিবর্তন বর্তমান বিশ্ব জনমানবের মূল চাহিদা। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রযন্ত্র তার সামাজিক চেহারা ঠিক রাখার জন্য সেবামূলক কর্মকা-কে সামনে রাখার চেষ্টায় অব্যাহত ভূমিকা রাখে। সমাজকল্যাণ রাষ্ট্রযন্ত্রের নীতিকৌশল নির্ধারণী প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সেবারাষ্ট্র ধারণার সৃষ্টিতে সক্ষম যা আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লক্ষ্য করি।
ক্যারিয়ার : সমাজকল্যাণের প্রয়োগিক দিকগুলো কী কী?
তৌহিদুল হক : বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোতে বিদ্যমান ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সামাজিক সমস্যা, অপরাধ, ভিক্টিম, স্থানীয় বিচার ব্যবস্থা সর্বোপরি ফলো-আপ অ্যাপ্রোচের মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা আনয়নে সমাজকল্যাণের পদ্ধতি ও কৌশলগুলো প্রয়োগ সম্ভব। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সমাজকল্যাণ ও এর সমস্যা নিয়ন্ত্রণমূলক প্রক্রিয়াকে সামাজিক সার্জারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ এর মাধ্যমে সমস্যার আঁতুরঘরে প্রবেশ সম্ভব, সম্ভব সমস্যা সমাধানের বাস্তবিক কৌশল মাঠপর্যায় থেকে লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীর নিকট থেকে সংগ্রহ করা। বিশ্বের মানবিক আন্দোলন যতটা সম্ভবপর হয়েছে তা সমাজকল্যাণের দার্শনিক ভিত্তির সাথে পারম্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় জড়িত।
ক্যারিয়ার : সমাজকল্যাণে অধ্যয়নরতদের খ-কালীন কাজের সুযোগ আছে কি না?
তৌহিদুল হক : বাংলাদেশে সমাজকল্যাণ বিষয়ে একাডেমিক চর্চা অর্ধশতাব্দী পার করলেও বেদনার সাথে বলতে হয় যে, যে পর্যায়ে সমাজকল্যাণের ক্ষেত্র পরিব্যাপ্ত হওয়ার কথা তা কিন্তু হয়নি। এই দোষ শুধুমাত্র রাষ্ট্র কিংবা উন্নয়নকামীদের নয়। তারপরেও সমাজকল্যাণে অধ্যয়নরতদের খ-কালীন কাজের সুযোগ যে নেই সে কথা বলছি না, তবে যে পরিমাণে থাকার কথা ছিল তা অর্জিত হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন সমাজ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে সমাজকল্যাণের সাথে জড়িত সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
ক্যারিয়ার : সমাজকল্যাণে উচ্চ শিক্ষিতদের ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ কেমন?
তৌহিদুল হক : বাংলাদেশে সরকারি চাকরি প্রক্রিয়ায় এখন সমাজকল্যাণ বিষয় থেকে ডিগ্রিধারীদের একটি স্বর্ণযুগ চলছে। কারণ সমাজকল্যাণের শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে সিলেবাসটি অনুসরণ করে তা রাষ্ট্রযন্ত্রেরও প্রত্যাশিত বিষয়। রাষ্ট্রযন্ত্র তার কর্মীদের মধ্যে যে গুণাবলীর সমন্বয় দেখতে চায় তা সমাজকর্মীদের একাডেমিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। তবে সমাজসেবামূলক সকল পদে সমাজকল্যাণ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্তদের যে অগ্রাধিকার ছিল তা সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে অতীতের কোন এক সরকার প্রধান। বর্তমান সরকারের অনুকূল দৃষ্টিভঙ্গি পারে সমাজকল্যাণে শিক্ষিতদের দেশ, সমাজসেবায় ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ প্রসারিত করতে, যার মাধ্যমে সরকার যা চায় তা বাস্তবায়ন ও অর্জন সম্ভব।
ক্যারিয়ার : দেশের বাহিরে উচ্চশিক্ষা ও কাজের সুযোগ কেমন?
তৌহিদুল হক : রাজনীতি ও উন্নয়নের বৈশ্বিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপটে আজ সমতা, উন্নয়ন, মানবাধিকার সবার দাবী, দাবী এমন একটি সময়ের যেখানে সবাই কল্যাণমূলক বেষ্টনীর ফ্রেমে আবদ্ধ থাকবে। মানবিক আন্দোলনের এই ধারাবাহিকতার মানবিক উন্নয়নের আদলে বিশ্ববাসী নিজ নিজ দেশে মানব সেবার লক্ষ্যে সেবামূলক কাজের প্রসারতা সৃষ্টি করছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশের বাহিরে সমাজকল্যাণ ক্ষেত্রে কাজের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে অধিকার ও মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায়বিচার, সামাজিক প্রগতিকে যেসব দেশ প্রাধান্য দেয়, সেই সমস্ত দেশ সমাজকল্যাণের ওপর একাডেমিক ও ব্যবহারিক পড়াশুনার ক্ষেত্র উন্মক্ত করেছে। যেখানে আমাদের দেশ থেকে সমাজকল্যাণের শিক্ষার্থীরা পড়ার যোগ্যতা পূরণের মাধ্যমে সমাজকল্যাণের একাডেমিক আলোচনাকে আরো প্রসারিত করতে পারে।
ক্যারিয়ার : যারা সমাজকল্যাণে পড়তে আগ্রহী তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
তৌহিদুল হক : সময়কে অস্বীকার করার সাহস আমার নেই। সময়ের তালে তালে বদল হয় জীবন। জীবনের আনুষঙ্গিক অঙ্গীকার তথা জীবন ও জীবিকার মূল দর্শন। সময়ের আদর্শিক কারণে একসময় যে বিষয়গুলোর কদর ছিল, সময়ের কারণেই তা আজ গুরুত্ব হাতে বসেছে। শিক্ষার্থীরা আজ চাকরির বাজারের সাথে মিল রেখে উচ্চশিক্ষার বিষয় পছন্দ করে যা সার্বিক অর্থে শিক্ষার ভাবগত অপমান ও জ্ঞানকে অর্থের বিনিময়ে ক্রয় ও অপছন্দের তালিকায় স্থান প্রদান। যে সমস্ত শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিকের পর উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসেবে সমাজকল্যাণ পড়তে আগ্রহী তাদের উদ্দেশ্য বলবো তারা সময়ের প্রয়োজনে সঠিক বিষয় যেমন নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। সেই সাথে সমাজকল্যাণের সিলেবাসটি শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাস কিংবা সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য ব্যবহার না করে সমাজের হৃদয় ও মানুষের তৎপরতা বুঝতে ব্যবহার করা উচিত। সমাজকল্যাণের শিক্ষার্থীদের সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এবং বিশ্বাসের জায়গায় স্থান দিবে এমন একটি পৃথিবী যেখানে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সবাইকে কাছাকাছি আনবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন