আমরা অনেক সময় ভাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ হোক, তারপর চাকরির খোঁজে নামব। পশ্চিমা দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের ধ্যান-ধারণা কিন্তু একটু আলাদা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই তাঁরা নানা রকম খণ্ডকালীন কাজ খুঁজতে শুরু করেন। গ্রীষ্মের ছুটিতে কেউ কেউ দুই মাসের জন্য একটা কাজে ঢুকে পড়েন। কেউবা ক্যাম্পাসেই টিচিং অ্যাসিসট্যান্ট, গবেষণা সহকারী বা এ ধরনের কোনো কাজে যোগ দেন। আমাদের দেশেও অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখার পাশাপাশি চাকরি করছেন। পড়ালেখা সামলে এর পাশাপাশি যদি চাকরির অভিজ্ঞতা নিতে পারেন, তাহলে কিন্তু পেশাজীবনের পথে আপনি আগেই এক ধাপ এগিয়ে থাকলেন। ভাবতে পারেন সুযোগ কোথায়, কে দেবে চাকরি? সে ক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্ন হলো, সুযোগ আপনি খুঁজছেন কি?
এগিয়ে থাকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র আলিমুল হাসান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রথমে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দেন, পরে খণ্ডকালীন চাকরি শুরু করেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়। একদিকে পড়াশোনা, আর অন্যদিকে কাজ করেছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট গবেষণা নিয়ে। আলিমুল বলছিলেন, ‘যেহেতু আমি আগেই আমার দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছি, তাই যেখানে খণ্ডকালীন চাকরি করতাম, পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর সেখানেই আমার নিয়োগ হয়ে গেল।’ আলিমুলের বন্ধুরা যখন সিভি তৈরি করে এদিক-ওদিক ছুটছেন, আলিমুল তত দিনে পুরোদস্তুর অফিস করতে শুরু করেছেন। বর্তমানে তিনি একটি জাপানি দাতা সংস্থায় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন।
একইভাবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী নিশাত আনজুমও পড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করেছেন। স্নাতকে পড়ার সময় তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে গবেষক হিসেবে খণ্ডকালীন চাকরিতে যোগ দেন। সেই চাকরির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ হতে না হতেই যোগ দিয়েছেন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়। নিশাত বলছিলেন, ‘খণ্ডকালীন চাকরিতে আর কিছু হোক বা না হোক, অভিজ্ঞতা হয়। তাই সুযোগ পাওয়ামাত্রই আমি সেটা কাজে লাগাতে দ্বিধা করিনি।’ এখন নিশাত আইন পেশার পাশাপাশি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধিবিষয়ক প্রকল্পে কাজ করছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী স্যাফায়ার হোসেন এখন পড়াশোনার পাশাপাশি অনুবাদক হিসেবে কাজ করছেন একটি বহুজাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। তিনি বলেন, ‘খণ্ডকালীন চাকরি করে আমি অনেক কিছু শেখার সুযোগ পাচ্ছি। যোগাযোগের দক্ষতা যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি অনেকের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি। নেটওয়ার্কিং হচ্ছে। বর্তমান সময়ের পেশার চাহিদাগুলো সম্পর্কে জানতে পারছি।’
আছে নানা রকম সুযোগ
কানাডাভিত্তিক স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান সাসটেইনেবল মাইগ্রেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইলিয়াস মাহমুদ বলেন, ‘দেশের বাইরে এমন কাজের সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা দারুণভাবে কাজে লাগান। আমাদের দেশে খুব বেশি দেখা না গেলেও অনেক তুখোড় শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন থেকেই খণ্ডকালীন চাকরিতে প্রবেশের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে তৈরি করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা রকম কাজে খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ পাওয়া যায়। আরও একটা সুবিধা হলো, এ ধরনের খণ্ডকালীন চাকরিতে খুব বেশি অভিজ্ঞতা বা দক্ষতার প্রয়োজন হয় না। শুধু প্রয়োজন একটা গোছানো সিভি আর কাজ করার আগ্রহ। কাজটি পেতে আপনি কতটা আগ্রহী, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ সাধারণত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগ আর বিপণন ও বিক্রয় বিভাগেই খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ বেশি থাকে। এ ছাড়া গবেষণা, যোগাযোগ, ইভেন্টস ও অ্যাকটিভেশন বিভাগেও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়মিত কাজের সুযোগ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
সেই সব প্রতিষ্ঠানেই মূলত বেশি সুযোগ পাওয়া যায়, যেখানে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা কম কিন্তু কাজের পরিমাণ বেশি বা বিভিন্ন প্রকল্পে যাদের খণ্ডকালীন কর্মীর প্রয়োজন হয়। খণ্ডকালীন চাকরির বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে খুব একটা চোখে পড়বে না। লিংকডইন, গ্লাসডোরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এ ধরনের চাকরির খবর পেতে পারেন। অনলাইনে এসব ওয়েবসাইট তাই সক্রিয় থাকতে হবে। এ ছাড়া গুগলে সার্চ করেও আপনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের খবর পেতে পারেন।
তরুণ পেশাজীবী নিশাত নায়লা পরামর্শ দিলেন, ‘খণ্ডকালীন চাকরির দারুণ একটি সুযোগ হচ্ছে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের জব বা ক্যারিয়ার অপশনে নিয়মিত চোখ রাখা। খণ্ডকালীন কর্মী, শিক্ষানবিশ, অ্যাসোসিয়েট হিসেবে বিভিন্ন কাজের সুযোগ নিয়মিতই বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবে দেখা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে সিভি জমা দেওয়ার সুযোগ আছে। সেখানে নিজের প্রোফাইল তৈরি করে রাখতে পারেন।’
যোগ্যতা যত
সাধারণত দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষ থেকেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে খণ্ডকালীন চাকরির জন্য আবেদন করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রথম যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পড়াশোনা। ইগলু লিমিটেডের গ্রুপ সিইও জিএম কামরুল হাসান জানান, ‘সাধারণ প্রযুক্তিগত দক্ষতা, যেমন মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ও এক্সেল জানা, টুকটাক ডিজাইন সম্পর্কে ধারণা রাখা, ইংরেজিতে লেখা ও বলার দক্ষতাকে যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়। বিভিন্ন সংগঠনে বা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে আপনার সিভিকে সমৃদ্ধ করবে।’
যেভাবে আবেদন করা যাবে
অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই এখন খণ্ডকালীন চাকরির জন্য আবেদন করা যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগ বরাবর ইমেইল করতে পারেন, সিভি জমা দিতে পারেন। চাইলে সরাসরি পছন্দের প্রতিষ্ঠানে হাজির হয়ে কথা বলে দেখতে পারেন, আপনার আগ্রহের কথা জানাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে পরিচিত কারও মাধ্যমে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
সুযোগ যেখানে
বাংলাদেশে কাজ করছে, এমন কয়েকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত বিভিন্ন বিভাগে খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক এনজিও, টেলিভিশন, আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থাসমূহের বিভিন্ন প্রকল্পে খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ দেখা যায়। ওয়ালটন, আগোরা, ম্যারিকো বাংলাদেশ, আড়ং, ডেলিগ্রাম টেকনোলজি, র্যাংগস মটরস, ইন্সপিরা অ্যাডভাইজরি ও কনসাল্টিং লিমিটেডসহ বিভিন্ন দেশি–বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ আছে।
কাজের মাত্রা
সাধারণত, প্রচলিত নিয়মে আট ঘণ্টা কাজ খণ্ডকালীন চাকরিতে করার প্রয়োজন হয় না। কখনো কখনো কাজের প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। এলিট পেইন্টের মানবসম্পদ বিভাগের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মোরাদ হোসেন বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ অনুসারে কাজের মাত্রা থাকে। যেহেতু নবীন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খণ্ডকালীন চাকরি করেন, তাই প্রতিষ্ঠানগুলোতে তেমন একটি কাজের চাপ থাকে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের কাজের চাপ কম ভেবে কাজ না করে নানা মাত্রার কাজ শেখার দিকে সুযোগ দেওয়া উচিত। বর্তমানে যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের বেশি বেশি প্রশ্ন করে তাঁদের কাছ থেকে সুযোগ ও কৌশলগুলো সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।
খণ্ডকালীন চাকরি কেন গুরুত্বপূর্ণ
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষা উন্নয়ন গবেষক মো. সাদ্দাম হোসেন মনে করেন, যেকোনো সুযোগ শিক্ষাজীবনে কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম ও প্রধানতম কাজ হচ্ছে পড়াশোনা। এরপরে ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে তৈরি করতে খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ নিতে হবে। এতে ভবিষ্যতের জন্য যেমন নিজেকে তৈরি করা যায়, তেমনি বিভিন্ন ব্যবহারিক দক্ষতা সম্পর্কেও গভীরভাবে জানা যায়।
যেসব বিষয়ে লক্ষ রাখবেন
● পড়ালেখাকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। পড়ালেখা সামলে যদি সম্ভব হয়, তাহলেই খণ্ডকালীন কাজে যোগ দিন।
● স্পষ্ট, নির্ভুল ভাষায়, গুছিয়ে একটি সিভি তৈরি করুন।
● কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভাইবার মাধ্যমে খণ্ডকালীন চাকরির সুযোগ পাওয়া যায়। তাই মৌখিক পরীক্ষার কৌশলগুলো জানতে হবে।
● সুযোগের খোঁজ রাখতে বিভিন্ন নামীদামি প্রতিষ্ঠানের লিংকডইন প্রোফাইল আর ওয়েবসাইটে নিয়মিত ঢুঁ মারতে হবে।
● রাস্তায় পাওয়া লিফলেট কিংবা পোস্টারে যদি কোনো খণ্ডকালীন চাকরির খবর দেখেন, এসবের ওপর আস্থা না রাখাই ভালো।
● পরিচিতদের মধ্যে যাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, তাঁদের জানান, আপনি একটি খণ্ডকালীন কাজ খুঁজছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলুন, আগ্রহ প্রকাশ করুন। সৌজন্যে- প্রথম আলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন