জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত শিল্পোন্নতির গোড়ার দিনগুলোতে জাতীয় ঐকতানে খাই খাই বন্ধ রাখতে পেরেছিল। ভারত-মালয়শিয়ার সরকারি কর্মচারি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপ্রধান দেশীয় গাড়ীতে চড়েছে, পুলিশ-সেনাবাহিনীর ব্যাবহৃত গাড়ী দেশে বানিয়েছে। আর আমাদের দেশে গার্মেন্টস আর প্রবাসী শ্রমিকের আয়ের টাকা কিংবা দান-দেনার টাকায় বিদেশ থেকে পাজেরো-পেট্রোল কেনা হয়।বিচার, শিল্প, ব্যাংকিং আর কাস্টমস এর মত প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করেনা। আসলে দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব ছাড়া কোন সেক্টরের সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ৯৭ শতাংশ সদস্য বিভিন্ন নেতিবাচক কার্যক্রমে জড়িত। এদের মধ্যে ৫৩ দশমিক ৫ ভাগ সদস্যই বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম, যেমন-হত্যা, দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও প্রতারণামূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত।
কেইস স্ট্যাডি এক :উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা
লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট হোসে মুজিকা আরাম-আয়েশের সরকারি সব সুযোগ দূরে ঠেলে, বিলাসবহুল সরকারি বাসভবনে না গিয়ে রাজধানী মন্টেভিডিও থেকে বেশ দূরে স্ত্রীর খামারবাড়িতে খুব সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করছেন। তিনি স্ত্রীর সঙ্গে ফুলের চাষ করেন। আয়ের বেশির ভাগ অংশই ব্যয় করেন দাতব্য কাজে।মুজিকার বাড়ির বাইরে কাপড় কাচার ঘর। মাঠের এক কূপ থেকে পানি তোলা হয়। কূপের চারপাশটা আগাছায় ভরা। প্রেসিডেন্টর এই বাসভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে মাত্র দুজন পুলিশ। আর রয়েছে তিন পেয়ে কুকুর ম্যানুয়েলা।২০১০ সালে তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল মাত্র এক হাজার ৮০০ ডলার। ২০১১ সালে স্ত্রীর অর্ধেক সম্পদ মিলে মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই লাখ ১৫ হাজার মার্কিন ডলার। মুজিকা তাঁর মাসিক আয়ের ৯০ শতাংশই দাতব্য কাজে দেন। এর মূল্যমান প্রায় ১২ হাজার মার্কিন ডলার।
মুজিকা ষাট ও সত্তরের দশকে উরুগুয়ের গেরিলা সংগঠন তুপামারোসের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। গেরিলা জীবনে তিনি ছয়বার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং ১৪ বছর কারাভোগ করেছেন। কঠোর শর্ত আর একাকিত্বের মধ্যেই বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে তাঁকে। দেশ গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরলে ১৯৮৫ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। তবে বন্দিজীবন তাঁকে এমন জীবনদর্শন শিখিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাকে বিশ্বের সবচেয়ে গরিব প্রেসিডেন্ট বলা হয়। আমার তা মনে হয় না। যারা শুধু ব্যয়বহুল জীবনযাপনের জন্য কাজ করে, সব সময় আরও বেশি বেশি চায়; তারাই গরিব। অনেক বেশি বিত্তবৈভব না থাকলে সারাজীবন শুধু দাসের মতো কাজ করার কোনো দরকার নেই; বরং ওই সময়টা নিজেকে দিন। আমাকে পাগল বা পালগাটে বৃদ্ধ মনে হতে পারে। কিন্তু এটা আমার নিজের পছন্দ।
টেকসই উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, বিশ্বে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তা দিয়ে কি ৭০০-৮০০ কোটি মানুষ একইভাবে ভোগ ও অপচয় করতে পারবে, যেটা উন্নত বিশ্ব করছে? এ ধরনের উচ্চ ভোগবাদ পৃথিবীর ক্ষতি করছে। ভোগবাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিশ্বনেতারা অন্ধ বলে তিনি তাঁদের সমালোচনা করেন।উরুগুয়ের জরিপ প্রতিষ্ঠানের ইগনাসিও জুয়াসনাবার বলেন, এমন জীবন যাপনের জন্য সাধারণ মানুষ প্রেসিডেন্টের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে সরকারের ভুল কাজের সমালোচনা করতে তারা পিছপা হয় না।
কেইস স্ট্যাডি দুই:ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ
আধুনিক বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাশীল প্রেসিডেন্টদের একজন।। তার বাবা একজন সামান্য কামার। সৎ,সাহসী,পরিশ্রমী,দূরদর্শী নেতা হিসেবে সারা বিশ্বেই আহমেদিনেজাদ আজ সমাদৃত। পেশায় তিনি ছিলেন একজন পি এইচ ডি ধারী তুখোড় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তেহরান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজির অধ্যাপক, ছিলেন তেহরানের মেয়র। ১৯৭৯ সালে ইরানের যে হাজার হাজার ছাত্র আমেরিকান দূতাবাস আক্রমণ করে ৫৩ জন কূটনীতিক কে বন্দী করে আহমেদিনেজাদ ছিলেন তাদের মধ্যে একজন।। একটি উন্নত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি সহজ সরলভাবে সৎ জীবন যাপন করেন।তিনি তেহরানের মেয়র থাকাকালে নিজ হাতে রাস্তায় ঝাড়ু দিতেন।এখন দুই রুমের একটা ছোট্ট বাড়িতে থাকেন।তার বাসায় দুই একটা কাঠের চেয়ার ছাড়া আর কোন আসবাবপত্র নেই।ঘরের ফ্লোরে একটা পুরনো কার্পেটের উপর বালিশ বিছিয়ে তারপর ঘুমান। তার বাসায় কোন শোয়ার খাট নেই।
তিনি প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তার ছেলে মাহাদির বিয়েতে মাত্র ৪৫ জন অতিথিকে(২৫ জন নারী এবং ২০ জন পুরুষ)নিমন্ত্রন করেন। তাকে যখন NBC নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিক এর কারন জিজ্ঞাসা করেন তখন তিনি অত্যন্ত হাসিমুখে বিনয়ের সাথে বলেন, এর চাইতে বেশি মানুষকে দাওয়াত দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। সেই বিয়েতে কোন ভোজের ব্যাবস্থা ছিলনা। প্রত্যেক অতিথি কে একটি কমলা,একটি কলা,একটি আপেল আর ছোট্ট এক টুকরো কেক দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল।তিনি সবার আগে সকাল ৭ টায় অফিসে যান।সকালে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিজের স্ত্রীর হাতের বানানো সকালের ব্রেকফাস্ট এবং দুপুরের খাবার একটা ছোট্ট কালো ব্যাগে করে সাথে নিয়ে যান। অফিসের কার্পেটের ফ্লোরে বসে তৃপ্তির সাথে সবার সামনে তিনি তার খাবার খান।দিনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় তিনি বাসার দারোয়ান, পথচারী ও সাধারন মানুষের সাথে কথা বলে তাদের সুখ দুঃখ শেয়ার করেন।তিনি যখনি কোন মন্ত্রীকে তার অফিসে ডাকেন তাকে একটা মন্ত্রণালয় চালানোর একটা দিকনির্দেশনা দিয়ে দেন। পাশাপাশি তিনি তাদের বলে দেন,রাস্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের ব্যাক্তিগত হিসাব নিকাশ ও তাদের নিকট আত্নীয় স্বজনের কার্যকলাপ কঠিনভাবে মনিটর করা হচ্ছে।
তার ব্যাক্তিগত সম্পত্তি বলতে তেহরানের বস্তিতে অবস্থিত ছোট্ট একটি বাড়ি,যা ৪০ বছর আগে তিনি তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। বাড়িটির নাম Peugeot 504. আপনি শুনলে অবাক হবেন তার ব্যাংক একাউন্টে বেতনের জমানো কিছু টাকা ছাড়া আর কিছু নেই। তেহরান ইউনিভার্সিটি তে তার বেতন মাত্র ২৫০ ইউ এস ডলার।তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাষ্ট্র থেকে কোন টাকা নেন না। তিনি ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাপ্ত বেতনের টাকা দিয়ে চলেন।BBC সাংবাদিক তাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “সব সম্পত্তি হল রাষ্ট্রের আর তার কাজ হল সেগুলো পাহারা দেওয়া”।তিনি এত বেশি পরিশ্রম করেন যে,তিনি সারাদিন ৩ ঘণ্টার বেশি ঘুমানোর সময় পান না। তিনি প্রতিদিন সকাল ৫ টায় ফযরের নামায পড়ে কাজ শুরু করেন আর রাত ২ টায় ব্যাক্তিগত স্টাডি ও এশার নামায পড়ে ঘুমাতে যান।তিনি কখনও নামায বাদ দেন না। নামাযের সময় হলে রাস্তায় ছোট্ট কাপড় বিছিয়ে নামায আদায় করেন। রাষ্ট্রীয় সব বড় বড় নামাযের জামাতে তিনি সব সময় পিছনের সারিতে সাধারন মানুষের সাথে বসতে ভালবাসেন।
কেইস স্ট্যাডি তিন :মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ
তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী।এক সকালে বুকের বাম পাশটায় ব্যাথা করছে। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আজ আট বছর ধরে। আগেও বেশ কয়েক বার এমন হয়েছে। শ্বাস নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে। আগে ব্যাথাটাকে গুরুত্ব না দিলেও আজকের ব্যাথাটা ক্রমশঃ বাড়ছে। শেষ পর্যন্ত ব্যাথা এতটাই অসহ্য হয়ে উঠলো যে তাকে দ্রুত কুয়ালালামপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। সারা মালয়েশিয়ার মধ্যে এখানেই আছে হৃদরোগের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা। পরীক্ষা করা হলো। ধরা পড়লো চর্বি জমে হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়েগেছে তিনটি শিরা। ডাক্তারি ভাষায় যাকে বলা হয় ব্লক। করতে হবে এনজিও প্লাস্টি (শিরার মধ্যে বেলুন ফুলিয়ে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা), কিন্তু হাসপাতালে নেই এনজিও প্লাস্টি করার সুবিধা। যেতে হবে পাশের দেশ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে।
কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদকে এ কথা জানাতেই তিনি ডাক্তারদের বললেন, “কোন দেশের প্রধানমন্ত্রীর অন্য দেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার অর্থই হলো সেই দেশের চিকিৎসা ব্যাবস্থা একদমই ভালো না। আমি তো অন্য দেশকে এটা জানাতে চাই না। আপনারা বলুন কত দিনের ভেতর এনজিও প্লাস্টির প্রযুক্তি দেশে আনতে পারবেন? বিদেশে গিয়ে আমি চিকিৎসা করাতে পারলেও আমার জনগণের তো সে সামর্থ নেই। প্রধানমন্ত্রী হয়ে আমি এটা পারবোনা। প্রযুক্তি দেশে আনুন। সেই প্রযুক্তিতেই আমার চিকিৎসা হবে।” ডাক্তাররা অনেকবার তাকে বুঝালেন। কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদ তাঁর সিদ্ধান্তে অটল।এর কিছুদিন পর এনজিও প্লাস্টি না করায় অবস্থা আরো খারাপ হলো মাহাথিরের। হার্ট এটাক হলো তাঁর। উপায়ন্তর না দেখে মালয়েশিয়ার চিকিৎসকরা করলেন হার্ট বাইপাস সার্জারী। সুস্থ হলেন মাহাথির মোহাম্মদ।এই ঘটনারও তিন বছর পর মাহাথির মোহাম্মদ এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্থাপিত হয়েছিলো ন্যাশনাল হার্ট ইনস্টিটিউট মালয়েশিয়া। আরো দুই বার হার্ট-এটাক হয়েছিল দেশপ্রেমী এ মানুষটির। প্রতিবারই তিনি চিকিৎসা নিয়েছিলেন তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত হার্ট ফাউন্ডেশনে।
কখনও কি এমনটা হবে যে বাংলাদেশে উপরোক্ত নেতাদের মত দেশপ্রেমিক,মানবপ্রেমিক মানুষেরাই বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্ব দিবে। নবীন প্রজন্মের সৎ, যোগ্য ও নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন