এই লেখা যখন লিখছি, বুধবার বিকেলে, তখন সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা পদ্ধতি একেবারে তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। লিখতে লিখতে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব দেখছিলাম। একটি সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন- 'কোটা নিয়ে যখন এত কিছু, তখন কোটাই থাকবে না। কোনো কোটারই দরকার নেই।' তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, 'কোটা থাকলেই সংস্কারের প্রশ্ন আসবে। এখন সংস্কার করলে আগামীতে আরেক দল আবারও সংস্কারের কথা বলবে। কোটা ব্যবস্থা বাদ, এটাই আমার পরিস্কার কথা।'
সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগ পর্যন্ত এই নিবন্ধের শিরোনাম হিসেবে ভাবছিলাম 'হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার'। কথাটি সাধারণত কাচের জিনিসপত্র পরিবহনের ক্ষেত্রে মোড়কের ওপর লেখা থাকে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও যেন শেষ পর্যন্ত রাজনীতির 'কাচঘর' হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এর সংবেদনশীলতা ও স্পর্শকাতরতা রাজনৈতিক দিক থেকে ছিল কাচের ঘরের মতোই। যে কোনো দিক থেকে একটি বেমক্কা ঢিলে চুরমার হয়ে রক্তারক্তি ঘটে যেতে পারত।
সরকারের দিক থেকে দেখলে, সাধারণ নির্বাচনের আর এক বছরও বাকি নেই। এই সময়ে সব সরকারেরই সবাইকে খুশি রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা থাকে। যত প্রয়োজনীয়ই হোক, অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করে আসা আওয়ামী লীগের পক্ষে কোটার ব্যাপারে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল।
কারণ এই কোটা ব্যবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্যদেরও অংশ রয়েছে। একই কারণে বিরোধী দলগুলোও কোটার বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে পারছিল না। বিশেষ করে বিএনপির জন্য এই পরিস্থিতি ছিল এক ধরনের শাখের করাত। এমনিতেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রশ্নে দলটির অবস্থান নিয়ে জনমানসে নানা ধারণা ও প্রশ্ন রয়েছে। কোটার প্রশ্নে নেতিবাচক অবস্থানকে সেই আলোকে ব্যাখ্যা করার লোকের অভাব নেই, বলা বাহুল্য।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ব্যাপকতাও বিশেষভাবে মনোযোগের দাবি রাখে। রোববার রাতে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে দেশের অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন শুধু ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ ছিল না। সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি যখন শিক্ষার্থীসাধারণের ক্যারিয়ারের বিষয়, তখন সেটা স্বভাবতই তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনেরও বিষয়। ফলে এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে কেবল হাজারো শিক্ষার্থীই নয়, পরোক্ষভাবে লাখো এমনকি কোটি নাগরিকেরও ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা রাজধানীর ভেতরের বিভিন্ন রাজপথ এবং দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধ শুরু করলে সড়ক যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটতে থাকে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার বিষয় তো ছিলই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ কোথাও কোথাও আন্দোলনটিকে বাজেভাবে 'হ্যান্ডেল' করতে গিয়ে আরও জটিল করে তোলে। এর মধ্যে রোববার গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের বাসভবন আক্রান্ত হয়। কোটা আন্দোলনের পুরো বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় সার্বিক আইন-শৃঙ্খলারও প্রশ্ন।
এ বিষয়ে আমার সন্দেহ সামান্য যে, আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিল নিছক সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে। প্রতিবছর কয়েক লাখ করে শিক্ষিত তরুণ দেশের কর্মবাজারে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। এর মধ্যে একটি বড় অংশ অবতীর্ণ হয় সরকারি চাকরি, বিশেষত সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে গৃহীত ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সংস্থার চাকরি প্রতিযোগিতায়। কমবেশি ৫৬ শতাংশের বেশি বিভিন্ন কোটার জন্য নির্ধারিত থাকায়, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী অনেকে পরীক্ষায় ভালো করেও শেষ পর্যন্ত সোনার হরিণের দেখা পায় না। তাদের ক্ষোভ এই কোটা পদ্ধতির ওপর গিয়ে জমা এবং ক্রমে অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছিল।
ফলে মাঝেমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোটা পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলে আসছিল। এ বছরের শুরু থেকে 'বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ' ব্যানারে শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক নানা কর্মসূচি। রোববার তারা 'ঐতিহাসিক' শাহবাগ মোড়ে অবস্থান গ্রহণ করে। রাতে পুলিশ তাদের পিটিয়ে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর আন্দোলন ও কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে। পরবর্তীকালে ক্রমেই আন্দোলন কীভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং জমায়েতগুলো ক্রমেই বৃহদাকার ধারণ করছিল, সেটা আগেই বলেছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন দানা বাঁধা এবং তা ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা নতুন নয়। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন, নব্বইয়ের 'স্বৈরাচারবিরোধী' আন্দোলন তো আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। ওয়ান-ইলেভেনের বেসামরিক মোড়কে সামরিক শাসনের বিদায়ও ত্বরান্বিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে যে অভূতপূর্ব 'গণজাগরণ' তার সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই। আরও স্পষ্ট করে বললে এই শাহবাগ চত্বরই। কোটা সংস্কার আন্দোলনও দৃশ্যত সফল হলো এখানে সূচিত হয়েই।
এবারের আন্দোলনের যে দিকটা আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে তা হচ্ছে, এর পরিণতমনস্ক চরিত্র। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক পটভূমিকা থেকে এসেও বিভিন্ন আন্দোলন বা তার নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক চেহারা দেখেছি আমরা। অনেকের মনে আছে, কানসাট বিদ্যুৎ আন্দোলনের নেতা পরবর্তীকালে কীভাবে রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে নির্বাচন করেছিলেন। এমনকি গণজাগরণ মঞ্চও কি তার অরাজনৈতিক চরিত্র ধরে রাখতে পেরেছিল? কোটা সংস্কার আন্দোলন সেদিক থেকে সফল।
যদিও কোনো কোনো মহল থেকে এটাকে নানা রঙ ও মোড়ক লাগানোর চেষ্টা চলেছে, আখেরে লাভ হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা, শুরু থেকেই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ সরকারকে এই বার্তা সুস্পষ্টভাবে দিতে চেয়েছে যে, এর সঙ্গে সরকারের বিরোধিতার কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি কোটা 'বাতিল' নয়, তারা যে কেবল 'সংস্কার' চায়, সে কথাও তারা বারংবার জোরের সঙ্গে বলে এসেছে।
আন্দোলনকারীদের আরেকটি সাফল্য তারা সব মতের লোকজনকে নিজেদের দাবির যৌক্তিকতা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যুক্তি দিয়েই। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে যুক্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সমিতি তাদের দাবির যৌক্তিকতা মেনে নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতিও দিয়েছে। এমনকি এই আন্দোলনের ডামাডোলে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন আক্রান্ত হয়েছিল, তিনিও বুধবার রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সহমত প্রকাশ করে। তিনি বলেছেন, 'কোটা সংস্কারের খুবই প্রয়োজন আছে, আমরা বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানিয়েছি।'
এখানেই শেষ নয়, প্রথম প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিভাত ছাত্রলীগের মধ্যম ও নিচু সারির নেতাদেরও কেউ কেউ প্রকাশ্যই কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ ও হল পর্যায়ের তিনজন নেতা এই ইস্যুতে পদত্যাগই করেছেন। প্রথম দিন, রোববারের একটি দৃশ্য পরবর্তীকালে আরও আন্দোলনের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে আমার ধারণা। তা হচ্ছে, মিছিলের পথ আগলে থাকা পুলিশের প্রতি আন্দোলনকারীদের গোলাপ উপহার। পুলিশ সঙ্গত কারণেই সেই 'ফুলেল শুভেচ্ছা' গ্রহণ করেনি। কিন্তু পথ ছেড়ে দিয়েছিল।
লক্ষণীয় আরেকটি বিষয়, আন্দোলনকারীদের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিটোল শ্রদ্ধাবোধ। বঙ্গবন্ধুই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি চাকরিতে বিশেষ কোটার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু কোটার ব্যাপ্তি যে বৈষম্যমূলক, সেটাই ছিল তাদের দিক থেকে আপত্তির। যে কারণে তাদের একটি স্লোগান খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে- 'বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নেই'। ছাত্রলীগের একটি পক্ষ তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, হামলা চালিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে নির্যাতনও করেছে; কিন্তু আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগকে বা ক্ষমতাসীন সরকারকে প্রতিপক্ষ বানাতে চায়নি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে বিভিন্ন জমায়েত ও মিছিলে 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' স্লোগান ছিল চোখে পড়ার মতো। আজ দুপুরেও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোটা সংস্কারের দাবিতে মিছিল যাচ্ছিল। খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গেই দেখলাম দৃপ্ত পায়ের সেই দীর্ঘ মিছিল থেকে ভেসে আসছে 'একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার' স্লোগান!
আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিও তাদের আস্থার ঘোষণা বারবার দিয়ে আসছে। তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের বৈঠকের পর একটি পক্ষ আন্দোলন স্থগিত করেছিল। কিন্তু আরেকটি পক্ষ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল এই দাবিতে যে, ঘোষণাটি 'প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে' আসতে হবে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের এমন পরিণতির মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ কি লাভবান হলো? আসলে কোটা সংস্কার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের হারাবার কিছু ছিল না। বরং নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতা এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের আস্থা পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। তবে এই পরিণতি আরও বিলম্বিত হলে ক্ষতির আশঙ্কা অমূলক ছিল না। যোগাযোগ ও পরিবহনে বিঘ্ন, শিক্ষা ব্যবস্থায় অচলাবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ছাড়াও ছাত্র ও ছাত্রীদের এত বড় বড় জমায়েতে নাশকতাও হতে পারত। তার নেপথ্যে যারাই থাকুক, দায় শেষ পর্যন্ত সরকারের কাঁধেই পড়ত।
বিরোধীদলীয় কিছু রাজনীতিক বা থিঙ্কট্যাঙ্কের পক্ষ থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করা বা উৎসাহিত করার প্রচেষ্টা যে চলেনি, তা নয়। সৌভাগ্যবশত 'কোমলমতি' আন্দোলনকারীরা 'পাকা মাথার' সেই ফাঁদে পা দেয়নি।
দুর্ভাগ্যবশত, আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বা মন্ত্রী কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিশেষ চরিত্র ও শক্তি অনুধাবনে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। এর সংবেদনশীলতা ও স্পর্শকাতরতা ধরতে পারেননি। তাদের বক্তব্য আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের যেমন বিক্ষুব্ধ করেছে, তেমনই আহত করেছে সাধারণ নাগরিকদেরও। 'হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার' বলতে চেয়েছিলাম তাদের উদ্দেশ্যেই।
সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন