বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চশিক্ষা, চাকরির পরীক্ষা এবং ভবিষ্যৎ পেশা নির্ধারণে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যে আমরা জানি এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা হচ্ছে না যদিও, শিক্ষার্থীরা অপেক্ষায় ছিল দীর্ঘদিন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা জানতে পারি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। এই মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে সঙ্গত কারণে জনমনে সংশয় আছে। উল্লিখিত দুটি পরীক্ষার সঙ্গে এইচএসসি পরীক্ষার বিষয় এবং সিলেবাসের অনেক অমিল আছে। এ ছাড়া জেএসসি পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সিরিয়াস থাকে না; কারণ এই পরীক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অনেকেই সতর্ক নয়। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি এই পরীক্ষা বাদ দেওয়ার পক্ষে।
সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এবার জেএসসি পরীক্ষার ফল এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়নে কাজে লাগবে এবং সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের বিগত দুই বছরের পড়াশোনাকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তাই বোর্ডের দুটি পরীক্ষার সঙ্গে কলেজের নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফলকে আংশিক মূল্যায়নের জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে। যদিও নির্বাচনী পরীক্ষার ফল নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। বিভিন্ন কলেজের মূল্যায়ন ভিন্ন, কেউ কম নম্বর দেয় আবার কেউ বেশি দিচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে বোর্ড পরীক্ষায় বিভিন্ন বোর্ডে প্রশ্ন ভিন্ন হয় এবং পরীক্ষক ভিন্ন থাকে তাই সেখানেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা যায় না। অনেকে শিক্ষক কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ভরসা রাখতে পারে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য। তারপরও সবকিছু বিবেচনায় আমি বলব, কলেজের নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফলকে কিছুটা প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে; যার মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের বিগত দুই বছরের পড়াশোনা গুরুত্ব পেত। অন্যথায় তারা একটা ফলাফল পাবে, যেখানে তাদের নিজের সম্প্রতি অর্জিত জ্ঞানের কোনো প্রভাব থাকবে না। পড়ালেখা কম করা শিক্ষার্থীদের জন্য সোনায় সোহাগা, অন্যপক্ষে যারা ভালো পড়ালেখা করেছে তাদের অবমূল্যায়ন করা।
মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে এই বছর একটা রেকর্ড হবে, যেখানে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করবে। অন্য একটি সমস্যা, উচ্চশিক্ষায় ১৩ লাখ আসন আছে কি? বাংলাদেশে সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন আছে প্রায় ৬০ হাজারটি, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজসহ সরকারি কলেজে চিকিৎসা পেশায় আছে ১০-১২ হাজার আসন। এ ছাড়া ১০৭টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন আছে প্রায় দুই লাখ এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন আছে প্রায় ৩৪ হাজারটি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এবং উপাদানকল্প প্রায় এক হাজার কলেজে ডিগ্রি (পাস) এবং স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে আসন আছে প্রায় ৯ লাখ। সবমিলে আসন আছে প্রায় ১২ লাখ; তবে এ বছর পাস করবে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ পরীক্ষার্থী। তাই সবাই উচ্চশিক্ষায় আসন পাবে কিনা- এ নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে, যদিও এটা সরকার চাইলে কলেজে আসন বাড়িয়ে সহজেই সমাধান করতে পারবে। কলেজের পাশাপাশি মাদ্রাসা বোর্ড থেকে পাস করা অনেকেই পড়তে পারবে বিভিন্ন মাদ্রাসায়। আশা করি, আসন নিয়ে সমস্যা হবে না। সঙ্গে থাকছে কারিগরি শিক্ষা।
এইচএসসি পাসের পর আমাদের দেশে শুরু হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা। এ বছর করোনার প্রকোপে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে হবে? কিন্তু প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে ফলাফল মূল্যায়ন করা হলে ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে প্রকৃত মেধাবীদের তাদের যোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানো অনেকটা অসম্ভব হবে। তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হলেও কোন পদ্ধতিতে হবে? এ বছর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবছে কিন্তু এ বিষয়টাও নিশ্চিত নয়। বুয়েট, ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আগেই বলেছে, গুচ্ছ পদ্ধতিতে যাবে না। তাহলে ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে হবে সে বিষয়ে ইউজিসি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের দ্রুত একটি যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। এত অনিশ্চয়তা নিয়ে দিন কাটছে দেশের সাড়ে ১৩ লাখ পরীক্ষার্থী এবং সংশ্নিষ্ট অভিভাবকদের। দীর্ঘ মেয়াদে অনিশ্চয়তা এবং দুশ্চিন্তার কারণে পরীক্ষার্থীদের অনেকেই ভুগতে পারেন মানসিক সমস্যায়।
তবে এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন নিয়ে একটি উচ্চ কমিটি গঠন করে মতামত নেওয়া যেতে পারে। কারণ এটি আমদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। তাদের সারাজীবন এই ফলাফল বয়ে বেড়াতে হবে। অনেকে এই ফলাফল কাজে লাগিয়ে বিদেশে যেতে চাইবে কিন্তু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় এ ফলাফল গ্রহণ করবে কিনা তাও ভাবতে হবে। অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত দ্রুত জানাতে পারলে শিক্ষার্থীদের মানসিক অসুস্থতা থেকে রক্ষা করতে পারবে। অন্যথায় এই প্রভাব পড়বে তাদের সারাজীবনে বিভিন্ন কাজকর্মে, এই শিক্ষার্থীরা আমাদের জাতীয় সম্পদ। পরিশেষে সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্ব সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের এই জাতীয় সম্পদ রক্ষা করার জন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেবে বলে প্রত্যাশা করি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন