বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা কীভাবে সাজালে পড়ালেখা শেষে একটা সমৃদ্ধ জীবনবৃত্তান্ত বা সিভি চাকরিদাতাদের সামনে উপস্থাপন করা যাবে, সেটাই জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) বিবিএ–র সাবেক চেয়ারপারসন, অধ্যাপক ড. মো. রিদওয়ানুল হক
জীবনের প্রথম জীবনবৃত্তান্ত বা সিভি লেখার মধ্যে একধরনের রোমাঞ্চ আছে। আমি যদি অন্য কারও সিভি দেখে হুবহু নকল করি, কিংবা সিভি লিখে দেওয়ার জন্য অন্য কারও দ্বারস্থ হই, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা—এই রোমাঞ্চ পুরোটাই মাঠে মারা যাবে। বরং বিষয়টাকে একধরনের ‘চাপ’ মনে হবে। কিন্তু গুগল সার্চ করে বিভিন্ন নমুনা দেখে, শিক্ষক বা সিনিয়রদের পরামর্শ নিয়ে, নিজের নামের পাশে অর্জনগুলো নিজেই সাজিয়ে লেখার মধ্যে একটা আনন্দ আছে। এই আনন্দ আরও উপভোগ্য হয়, যদি লেখার মতো কিছু থাকে। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম আর সিজিপিএ দেখে কাউকে যাচাই করা কঠিন। তাই চাকরিদাতারা সিভিতে আরও কিছু দেখতে চান, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আপনার যোগ্যতা ফুটে উঠবে।
ভবিষ্যতের প্রস্তুতি কিন্তু ভবিষ্যতে নেওয়া যায় না। নিতে হয় বর্তমান থেকে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকেই এমনভাবে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, যেন একটা সমৃদ্ধ সিভি তৈরি করতে পারেন।
চার বর্ষের সার কথা
প্রথম বর্ষ
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে পা রাখার পর শুরুর সময়টা রোমাঞ্চকর, কিন্তু এই সময়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলা যাবে না। নিয়মিত ক্লাসে অংশগ্রহণের পাশাপাশি ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে নেটওয়ার্ক তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব, অ্যালামনাই নেটওয়ার্কসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। খুঁজে দেখুন, কী ধরনের কার্যক্রমে আপনার আগ্রহ আছে। শিক্ষাজীবনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা আপনার হয়েছে কি না, চাকরির আবেদনে সেটি গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন বা সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই অভিজ্ঞতা হতে পারে। প্রথম বর্ষে নিজের সাধারণ দক্ষতা—যেমন ইংরেজি ও বাংলায় শুদ্ধভাবে কথা বলার দিকে জোর দিতে হবে। তৃতীয় কোনো ভাষা শিখতে চাইলে সেটাও শুরু করে দিন। ফরাসি, জাপানি কিংবা চীনা ভাষার দক্ষতা আপনার জন্য নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রের দরজা খুলে দেবে।
যেসব দিকে জোর দেবেন: দলের সঙ্গে কাজ করার সক্ষমতা, ভাষা ও যোগাযোগের দক্ষতা, সৃজনশীল মনন তৈরি।
দ্বিতীয় বর্ষ
এই সময়ে সাধারণত পড়াশোনার চাপ বাড়তে থাকে। তারপরও নিয়মিতভাবে ক্লাসের বাইরে কোনো প্রকল্প বা প্রাথমিক পর্যায়ের কাজে নিজেকে যুক্ত করা যেতে পারে। স্বেচ্ছাসেবক, অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষক, অনুবাদকের মতো ছোটখাটো কাজ খুঁজতে হবে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। প্রযুক্তিভাবে দক্ষ হওয়ার জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। কম্পিউটারসংক্রান্ত দক্ষতা যেমন মাইক্রোসফট ওয়ার্ড আর এক্সেল ধীরে ধীরে পেশাদার পর্যায়ে শিখতে হবে। যে বিষয়েই পড়ুন না কেন; মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, ছবি সম্পাদনা, ভিডিও সম্পাদনা—এসব সম্পর্কে ধারণা থাকা দরকার। দ্বিতীয় বর্ষে সমস্যা সমাধানের চেয়ে সমস্যাকে নিয়ে ভাবনার কৌশল আয়ত্তের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। ক্লাস প্রেজেন্টেশন তৈরি, উপস্থাপনা, আইডিয়া পেপার তৈরি করা শেখার মাধ্যমে অনেকের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার চর্চা করুন। বিষয়ভিত্তিক পড়ার বইয়ের বাইরে কারিগরি দক্ষতা বিকাশবিষয়ক বই পড়তে হবে।
যেসব দিকে জোর দেবেন: প্রযুক্তিগত কারিগরি দক্ষতা অর্জন, অনেকের সামনে বক্তব্য দেওয়া বা পাবলিক স্পিকিং, বাংলা ও ইংরেজিতে নির্ভুলভাবে লেখা ও কথা বলা।
তৃতীয় বর্ষ
শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের কর্মক্ষেত্র নিয়ে সাধারণত ভাবতে শুরু করে এই সময় থেকে। চাকরির জন্য দুশ্চিন্তা না করে গবেষণা, থিসিস পেপার তৈরি, দেশ বা বিদেশের কোনো সম্মেলনে অংশগ্রহণের মতো পড়াশোনাকেন্দ্রিক কাজে যুক্ত হতে পারেন। নিবন্ধ লেখা, পেশাদার প্রেজেন্টেশন তৈরি, উপস্থাপনসহ প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে আরও জোর দিতে হবে। আবেগকেন্দ্রিক বুদ্ধিমত্তা বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে জানা শুরু করতে হবে। ভবিষ্যতে যে পেশায় কাজ করতে চান কিংবা যে বিষয়ে পড়ছেন, সেই বিষয়ক কিছু সার্টিফিকেশন কোর্স করতে পারেন। অনলাইনে এডেক্স বা কোর্সেরার মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে কোর্স করা যায়। এ সময় শখ বা আগ্রহ থেকে নিজের কোনো স্টার্টআপ, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন তৈরি করে পরবর্তী জীবনের জন্য এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারেন। সুযোগ থাকলে, অবসরে কোনো খণ্ডকালীন চাকরি বা গবেষণা করতে পারেন। বিভিন্ন গবেষণা নিবন্ধে লেখা প্রকাশের চেষ্টা শুরু করুন। জীবনবৃত্তান্ত বা সিভি লেখাও এই সময় থেকেই শুরু করা উচিত।
যেসব দিকে জোর দেবেন: আবেগকেন্দ্রিক বুদ্ধিমত্তা বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্সের বিভিন্ন বিষয়, দল পরিচালনা, নিবন্ধ লেখা, গবেষণার প্রস্তাব (রিসার্চ প্রপোজাল) ও গবেষণা নিবন্ধ তৈরির ধারণা, প্রতিষ্ঠান ও দল ব্যবস্থাপনা, ই–মেইল লেখা।
চতুর্থ বর্ষ
নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা মোটামুটি চিত্র চোখের সামনে ভাসে চতুর্থ বর্ষে এসে। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার আগ্রহ থাকলে জিআরই, টোয়েফল বা আইইএলটিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে এই সময় থেকে। পেশা খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখতে পারেন (ইন্ডাস্ট্রি ট্যুর)। বিভিন্ন পেশা খাতে কী হচ্ছে, সে সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। সেই পেশায় এখন কোন দক্ষতাগুলোর গুরুত্ব বেশি, তা বিকাশের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। দুই–তিন দিনের সংক্ষিপ্ত কর্মশালায় অংশগ্রহণ করা যেতে পারে। যাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, তাঁদের সঙ্গে লিংকডইন বা অন্য কোনো নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। স্নাতকের অংশ হিসেবে ইন্টার্নশিপের (শিক্ষানবিশ) নিয়ম না থাকলেও, নিজেই সুযোগ খুঁজতে হবে। শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা সিভিতে ভূমিকা রাখে।
যেসব দিকে জোর দেবেন: প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করার কৌশল, আচরণ ও নিয়মকানুন, নিজেকে উপস্থাপন, হাতে-কলমে কাজের অভিজ্ঞতা।
সবার আগে পড়াশোনা
ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ। আপনি যেই প্রতিষ্ঠানে, যেই বিষয়েই পড়েন না কেন, সবার আগে অগ্রাধিকার পাবে পড়াশোনা। আরও নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে আত্ম–উন্নয়ন করতে হবে, দক্ষতা অর্জন করতে হবে, কিন্তু পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়লে চলবে না। নিয়মিত ক্লাসে অংশ নিতে হবে। ছোট-বড় পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন—সবকিছুকে গুরুত্ব দিতে হবে। সিভিতে সিজিপিএই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তো বটেই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন