শ্রীলংকা যাওয়ার সিদ্ধান্তটা একদমই হুট করে মাথায় আসা। যাওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহ আগে সিদ্ধান্ত নিই যে যাবো। গিয়েছিলাম সার্ভিস সিভিল ইন্টারন্যাশনালের একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেখানকার একটা ওয়ার্কক্যাম্পে অংশ নিতে। ভাবলাম এতে স্থানীয়দের সাথে মেশার সুযোগটা আরও বেশি হবে হয়তো। আবার কিছুটা দ্বিধায়ও ছিলাম কারণ এর আগে কখনোই দেশের বাইরে একা কোথাও যাইনি। তবে জীবনে অন্তত একটা সলো ট্রাভেল করার ইচ্ছা আমার ছিল, সেই স্বপ্ন পূরণ করার লোভ সামলাতে না পেরেই চলে গেলাম শ্রীলংকা।
বাংলাদেশ থেকে আমি একাই গিয়েছিলাম, মধ্যরাত ২টায় পৌঁছাই কলম্বো বিমানবন্দরে। সেখানে আমাকে নিতে আসে মাহিম। আমার সাথে পরিচয় হওয়া প্রথম কোনো লংকান। দুজন মিলে একসাথে সেই রাতেই চলে গেলাম ক্যান্ডি। সেখানে আমার স্থান হলো ব্লুরোজ স্পেশাল স্কুলের একটি ডরমিটরিতে। ভোররাতে গিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই তখন বুঝতে পারিনি যে কই আছি আমি। সকালে উঠে দেখি স্কুলটি একটি পাহাড়ের উপরে, পাশেই খরস্রোতা মাহাভেলি নদী, আর বিশাল বনে বানরেরা লাফালাফি করছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ও ভোরে সেখানে লাখ লাখ বাঁদূর উড়তে দেখতাম।
ক্যান্ডির সেই ক্যাম্পে ছিলাম ৯টি দিন। এই নয় দিন আমার সাথে আরও ছিল ডেনমার্কের পাঁচজন, ইতালির একজন আর শ্রীলঙ্কা্র বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এসেছিল ১০-১২ জন। এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষই ছিল। কিন্তু এই নয় দিন আমরা এক ছাদের নিচে একটি পরিবারের মতো থেকেছি। দিনভর বিভিন্ন রকমের কাজ আর ঘোরাঘুরি, রাতে খেলতাম Uno! আমরা সবাই মিলে সেই স্কুলটি পরিষ্কার করেছি, মাটি আর পাথর কেটে বাচ্চাদের জন্য খেলার জায়গা তৈরি করেছি। দুইটা গ্রামের স্কুলে গিয়ে গাছ লাগিয়েছি, বাগান পরিষ্কার করেছি। আর শেষ দুইটা দিন ক্যান্ডির রাস্তায় রাস্তায় কিডনি রোগীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছি।
আমরা সবাই একসঙ্গে প্যাগোডায় গিয়েছি, চার্চে ও মন্দিরে গিয়েছি। এমনকি একসাথে ঈদও উদযাপন করেছি। কারণ প্রতিটা সমই আমরা একে অপরকে আগে মানুষ হিসেবে দেখেছি। এখানকার প্রতিটা অভিজ্ঞতাই ছিল দুর্দান্ত! গ্রামের বাচ্চাদের সাথে ফুটবল খেলা, একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, পেরেহেরা উৎসব দেখা, একসাথে গান গাওয়া, সেখানে ঈদ উদযাপন করা প্রতিটি সময় ছিল উপভোগ্য। শুধু ঘোরার উদ্দেশ্য নিয়ে গেলে হয়তোবা এইসব অভিজ্ঞতা হতো না।
বেশিরভাগ শ্রীলংকানই শুরুতে ভাবতো আমি লঙ্কান, পরে বাংলাদেশি বললে তারা কৌতূহল ভরা একটা হাসি দিত। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের ধারণা ক্রিকেট পর্যন্তই আছে, তাই আমার দেশ সম্পর্কে জানার কৌতূহল সবারই ছিল বেশি। কিছু ছেলেপেলে আমাকে দেখলেই খালি বাংলাদেশ-শ্রীলংকার সিরিজের ট্রেডমার্ক খ্যাত 'নাগিন ড্যান্স' দিত। তবে এখানকার মানুষ অসম্ভব অতিথিপরায়ণ আর বাংলাদেশিদের নিজেদের বন্ধু হিসেবে দেখে! তাদের মধ্যে অপরকে সাহায্য করার একটা রীতি আছে। সব কাজকে এবং সব পেশার মানুষদেরকে এরা সমানভাবে দেখে। শ্রেণিবৈষম্য এদের মাঝে নেই। আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চমৎকার এক দেশ মনে হয়েছে আমার শ্রীলংকাকে।
দেশটিতে গিয়েছিলাম আমি একা, কিন্তু এই ক্যাম্প শেষে কিছু চমৎকার বন্ধু রেখে এসেছি। এখন শ্রীলংকার বিভিন্ন প্রান্তে আমার বন্ধু আছে। কখনো ভাবিনি এই শ্রীলঙ্কায় এসে কোনো একটি গার্ডেন ভ্যালিতে বসে জ্যোৎস্না দেখতে পারব। কিন্তু আমারই এক বন্ধু ভিনোদের বাড়ি মেফিল্ড টিস্টেটে, স্বর্গীয় এক জায়গা! ইচ্ছা ছিল একা শ্রীলংকা ঘুরব কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। যেদিকেই গিয়েছি সাথে বন্ধুবান্ধব ছিল। তাদের বাসায় থেকেছি, খেয়েছি। মাত্র নয় দিনের পরিচয়ে মনে হয়েছিল আমি তাদেরই পরিবারের কেউ। এই আন্তরিকতা ও ভালোবাসা কখনো ভুলবার নয়।
শেষ দিনটি আমি কলম্বোতে একা একা ঘুরেছিলাম কিন্তু আমার বন্ধু মনোজ, ভিনোদ আর ছোট ভাই প্রাসান্ত ক্ষণে ক্ষণে আমার ফোন দিয়ে খোঁজ নিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমাকে নিয়ে আমার থেকে তাদের দুশ্চিন্তাটাই বেশি। দেশে ফিরতি পথেও খোঁজ নিচ্ছিল যে আমি ঠিকমত যাচ্ছি কি না। অথচ এই মানুষগুলোর সাথে আমার পরিচয় মাত্র ১১ দিনের।
প্রতিটা সফরেরই অসংখ্য গল্প থাকে, তৈরি হয় অসংখ্য স্মৃতি। শ্রীলংকা ভ্রমণও এর ব্যতিক্রম নয়। ফেরত যাওয়ার দিন আমার বন্ধুগুলা বলছিল যে পরেরবার এলে আমাকে তারা কই কই নিয়ে যাবে। কিন্তু সেই পরেরবার যাওয়া হবে কি না আমি জানি না। মানুষের আয়ু খুব অল্প, কিন্তু এই পৃথিবীটা অনেক বিশাল। এই স্বল্প আয়ু নিয়েও স্বপ্নের পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আরও অনেক কিছু দেখার আছে, শেখার আছে, অনেক মানুষের সাথে মিশতে হবে, জানতে হবে। এই রকম আরও গল্প তৈরি করতে চাই।
যত ঘুরি নিজেকে তত ক্ষুদ্র মনে হয়, কিন্তু এই ক্ষুদ্র মানুষটাই চায় সমস্ত পৃথিবী সাবাড় করতে। আর তখনই এক ট্যুর শেষ করার আগেই মাথায় ঠিক করে রাখি যে পরেরবার কই যাবো। আর ভাবি এইটা তো সবে মাত্র শুরু, কিন্তু এই শুরু ভাবতে ভাবতেই তো কম ঘোরাঘুরি করলাম না। তাও মনে হয় কিছুই দেখলাম না। সম্ভবত প্রতিটা ভ্রমণের পর নিজেকে নতুনভাবে বুঝতে ও চিনতে পারার কারণেই প্রতিটা ট্যুরকেই মনে হয় 'এই তো কেবল শুরু!' তবে আমি চাই এই শুরুর যেন কোনো শেষ না হোক, যদি ভ্রমণ নেশা হয় তাইলে এই নেশার কোনো নিরাময় আমি চাই না।
জানি না ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে, ভালো হোক মন্দ হোক। তবে ক্যান্ডির রাস্তায় কিডনি সোসাইটির জন্য অর্থ সংগ্রহ করার স্মৃতিটা অম্লান হয়ে থাকবে। সেদিন আমি বাংলাদেশের পতাকা আর মানচিত্র ছাপানো টিশার্ট পরেছিলাম বলে আমার বাক্সে অর্থ জমা হচ্ছিল সবচেয়ে বেশি। কেউ কেউ আমাকে উল্টো ধন্যবাদ জানাচ্ছিল তাদের দেশে এসে এসব কাজে অংশ নিয়েছি বলে। দেশে ফিরে এই সবই এখন অনেক বড় প্রাপ্তি মনে হচ্ছে। এবার চেষ্টা করবো নিজের দেশের মানুষদের কীভাবে প্রতিদান দিতে পারি। কারণ কাউকে নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করার আনন্দ অর্থ-বিত্ত লাভের থেকে অনেক অনেক বেশি।
সাজ্জাদ আহমেদ নিপু: উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও শিশু অধিকার কর্মী। ইমেইল-nipusajjad@gmail.com
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন