নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি রাজনৈতিক অংশ। এই রাজনৈতিক অংশ নির্ধারিত সময়ের পরে কিংবা সময়ানুযায়ী ক্ষমতা বদলে জনগণকে সম্পৃক্ত করে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্দেশনা প্রদান করে। নির্দেশনা প্রদানের অংশ হিসেবে জনগণের চাহিদা মাথায় রেখে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করে, প্রচার করে এবং জনসমর্থন আদায়ের জন্য কাজ করে। প্রতিটি নির্বাচনেই তরুণদের চাহিদা ও প্রত্যাশাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট ভোটারের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা হলো তরুণ ভোটার। যারা নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার ক্ষমতা রাখে। আসলে, তরুণরা তারুণ্যের ক্ষমতায় শক্তিশালী, ঝুঁকি নেওয়ার মতো সাহস ও উদ্দীপনা রাখে।
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তরুণরা কী চায়? তরুণদের চাওয়া খুবই স্পষ্ট ও সময়ের দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সেই প্রত্যাশা ও দাবিগুলো যে রাজনৈতিক দল বা জোট প্রাধান্য দেবে, তরুণরা সেখানেই তাদের ভোটাধিকার ব্যক্ত করবে। তরুণদের এই প্রত্যাশাগুলো কী? বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। গল্প শুনেছে, বইতে পড়েছে, মুভি বা নাটকে দেখেছে। মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক চেতনা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অনর্থক বিতর্ক দেখেছে! এর মধ্য দিয়েই তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, প্রত্যাশা আলাদা করে মাত্রা পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নমাখা বাংলাদেশ প্রতিটি তরুণের আকুতি। তারুণ্যের শক্তি চায়- বাংলাদেশ জন্মের মূল শিকড়ের চর্চা হোক সর্বত্র। মানুষ ফিরে পাক মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের আদল, সর্বত্র। কারণ, যে প্রজন্ম দেশ সৃষ্টি দেখেনি, নিশ্চয়ই যে দল মুক্তিযুদ্ধের কথা বলবে, দেশ সৃষ্টির ইতিহাসকে প্রাধান্য দেবে, তরুণরা তাদের ভালোবাসবে ও সমর্থন জানাবে।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের উন্নয়নের পরিবর্তে নিজেদের উন্নয়ন ও অহমিকা প্রতিষ্ঠায় বেশি নিয়োজিত থেকেছে। সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহারে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন তরুণদের নতুন করে উদ্দীপিত করেছে। বিশ্বায়নের তাগিদে তরুণরা যা পেতে চেয়েছে, সেই ঘোষণাটিই একটি রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক উত্থাপিত হওয়ায় তরুণরা সমর্থন দিয়েছে। যদিও প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক অপরাধ, জঙ্গিবাদ ও সহিংস আচরণ হয়েছে। তারপরও প্রযুক্তির ব্যবহার তরুণদের এ দেশে থেকেই নতুন কিছু করার প্রেরণা দিয়েছে, পেয়েছে রাষ্ট্রীয় সমর্থন ও সুযোগ। বিএনপি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে। নিশ্চয়ই তারাও নির্বাচনী ইশতেহারে প্রযুক্তির ব্যবহার ও এ ক্ষেত্রে তরুণদের চাহিদার প্রতি সমর্থন দেবে।
তরুণদের একটি অংশ সমাজের সনাতনী বিশ্বাস উপেক্ষা করে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেছে। দীর্ঘদিনের শাসিত ও শোষিত সমাজ চায় নিশ্চয়তা। আর সেই নিশ্চয়তার আশ্রয়স্থল সরকারি চাকরি বা বলার মতো একটি চাকরি। এই ধারণা ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তরুণরা রাষ্ট্রীয় সমর্থন প্রত্যাশা করে। তারুণ্য সব ধরনের অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত শক্তি। দুর্নীতির প্রতি তারুণ্যের ঘৃণা মজ্জাগত, এই দুর্নীতির কারণেই মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় তরুণরা উন্নত দেশের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। তবে এটি ঠিক যে, দুর্নীতি এমন একটি সামাজিক ও আচরণগত অসুখ, যা নিরসনে সমবেত উদ্যোগ জরুরি। প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন এবং দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা ও দৃঢ় সংকল্প।
পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাস ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লক্ষণীয়, তারুণ্যের শক্তি প্রথম সোচ্চার হয়েছে বৈষম্য নিরসনে এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। বাংলাদেশে বর্তমানে পণ্যবাজার ও মূল্য নির্ধারণে সরকারের ভূমিকা মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে এক ধরনের আচরণগত বিচ্ছিন্নকরণ স্বভাবের সৃষ্টি করেছে। সামাজিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে অনেকটাই হিমশিম খাচ্ছে। এর ফলে মধ্যবিত্ত আলাদাভাবে পরিচিত এবং বাণিজ্যগত দুর্নীতির দাপট মেনে নিয়ে সমাজের মানবিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে মানুষ পরস্পর থেকে অনেকটাই দূরে অবস্থান করছে। সবাই নিজের অবস্থান, মর্যাদা, সম্মান, অর্থ প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত। এভাবে একটি মানবিক ও সহনশীল সমাজ তৈরি হতে পারে না। তাই নির্বাচনী ইশতেহারে সামাজিক বৈষম্য নিরসন, পরস্পর বিচ্ছিন্নকরণ আচরণ পরিহারে সামাজিক সম্প্রীতির কর্মসূচি প্রণয়নপূর্বক বাস্তবায়ন জরুরি। মোদ্দা কথা, তারুণ্য চায় সেই বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ স্বপ্নে বিভোর মুক্তিযুদ্ধে, অর্থনৈতিক আন্দোলনে সবার অংশগ্রহণ ও গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ, মানবিক সম্পর্কের সর্বোচ্চ চর্চা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন একটি সম্পর্ক, যা উন্নয়ন ও প্রগতিকে ব্যাহত না করে। যে দল বা রাজনৈতিক জোট তারুণ্যের এই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবে, তরুণরা সেই জোট বা দলের প্রতি সমুন্নত থাকবে এবং জয়ী হতে তারুণ্যের শক্তির প্রয়োগ ঘটাবে। আশা করি, তারুণ্যের প্রত্যাশার প্রতি রাজনৈতিক জোটগুলো যৌক্তিক প্রক্রিয়ায় সচেতন থাকবে।
সহকারী অধ্যাপক, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
tawohid@gmail.com
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন