এই বিষয়টি নিয়ে বহুদিন হলো লিখব ভাবছিলাম। কিন্তু লিখা হয়ে উঠছে না। তাই আজ আবার নতুন করে হাত দিলাম লেখায়। যাহোক সেদিন একটি কাজে গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রামের দৃশ্যপট অনেক পাল্টে গেছে। আমরা ছোট্টবেলায় যেখানে হাফপ্যান্ট (ইংলিশ প্যান্ট) বা লুঙ্গি পরতাম আর এখন কেউ তা পরে না। জিন্সের প্যান্ট পরেই ছেলেরা মাঠে ময়দানে ঘুরে বেড়ায়, এমনকি মাঠে কাজও করে। গ্রামের চারদিকে ছোট ছোট চায়ের দোকান হয়েছে। সেখানে লোকজন নিয়ম করে চা পান করছে আর আড্ডাতে মশগুল। আছে বাংলা আর তামিল সিনেমা দেখার সুযোগ আবার কখনো কখনো দেশ দুনিয়ার সংবাদ। এক সময় নারীরা ঘরের কাজের বাইরে কিছু না করলেও এখন তারা ঢাকা শহরে চাকরি করে। আবার কেউ কেউ সরকারি, বেসরকারি কাজেও যুক্ত হয়ে পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করছে। গ্রামের ছেলে আল আমিন (ছদ্মনাম) মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের সন্তান। সে এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে আর ভর্তির সঙ্গে সঙ্গেই শর্তানুযায়ী তার বাবা তাকে একটি পালসার মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছে যার বাজার মূল্য প্রায় দুই লাখ টাকা। সে সকাল বেলায় গ্রামের রাস্তা দিয়ে অনেক গতিতে বাইক চালিয়ে যায় চোখে রোদ চশমা দিয়ে। দেখতে ভালো লাগে ছেলেটাকে।
গ্রামের আরেক ছেলে শাকিল (ছদ্মনাম) সম্পর্কে শুনলাম সে ইয়াবায় আসক্ত। অথচ কি মেধাবী ছেলে ছিল সে। তার হাতের লেখা ছিল মুক্তর মতো। আমরা মাঝে দেয়াল পত্রিকা করতাম আর সে সময় তার লেখাটাই সবার নজর কাড়ত। সে আজ প্রায় ভিন্ন পথের যাত্রী। বাবা-মা আর একমাত্র বোনের সঙ্গে তার বিশাল দূরত্ব। বন্ধুরাও তার থেকে দূরে দূরে থাকে। এমন হাজারো তরুণ আজ নানান ধরনের নেশায় আসক্ত।
শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান সাবিলা (ছদ্মনাম)। প্রতিদিন তার সকালে উঠতে দেরি হয় আর বাবা বকাঝকা করে। কিন্তু সে কি করবে। বন্ধুরা সারারাত ধরে কত আড্ডা দেয় আর অনলাইনে মাস্তি করে। সেকি তাদের সঙ্গ ছেড়ে ঘুমাতে পারে। তাইতো প্রতিদিন ভোর হয়ে যায় তার ঘুমাতে আর যথারীতি সকালে উঠতেও দেরি। ক্লাস করতে তার একটুও ভালো লাগে না। সে চায় সব সময় তার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর মজা করতে। সেলফি আর লাইক, কমেন্টের এক ভয়াবহ প্রতিযোগিতা চলে তাদের মধ্যে। তার এত সময় নেই দেশ দুনিয়া নিয়ে ভাববার। তবে গø্যামার জগৎ তার নখদর্পণে।
মহান শিক্ষা দিবস চলে গেল। ঢাকা শহরের দুজন তরুণকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে শিক্ষা দিবস সম্পর্কে জানেন কিনা। তাদের পাল্টা প্রশ্ন ছিল শিক্ষা দিবস কি? একজনের আচরণ ছিল এটি জানাটা জরুরি কিনা। একইভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কোনো দিবস বা ইস্যুতেও তরুণদের নির্লিপ্ততা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাদের আকর্ষণের বিষয়বস্তু একটু যেন আলাদা, একটু অন্যরকম। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ইতিহাস, ঐতিহ্য আর গৌরব তাদের ঠিক আমাদের মতন করে স্পর্শ করে না। তারা অনেক বেশি তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর হয়ে বাঁচতে চায়, ভাবতে চায়। বর্তমান ছাত্র ও তরুণ সমাজ রাজনীতি বিমুখ। কিন্তু রাজনীতির সার্বিক কর্মকাণ্ডের দ্বারা তারা প্রভাবিত। শুধু তাই নয়, রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবও তাদের ওপর পড়ছে। বর্তমান সরকার এই তরুণ সমাজকে নিয়ে তার ভাবনা বিগত দিনে তাদের ভাবনায় প্রকাশ করেছিল। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোও তাদের নির্বাচনী ভাবনা, দলীয় কর্মপরিকল্পনায় তারুণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তারুণ্যের এই শক্তি ব্যাপক। ভোটের হিসাবেও এটিকে গুরুত্ব না দেয়ার সুযোগ নেই কারো।
বিশ্বের দেশে দেশে নানান পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে যুগে যুগে ভূমিকা পালন করছে তরুণরা। সেটা বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও যেভাবে হচ্ছে একইভাবে হচ্ছে লেটিন আমেরিকার দেশে দেশে, এশিয়া ইউরোপেও। তরুণরা দেখতে চায় সৎ, মেধাবী, আকর্ষণীয়, জবাবদিহিতা, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও গতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা ও নেতৃত্ব। ডায়নামিক নেতৃত্বও তরুণদের আকর্ষণ করে। যে কোনো কালাকানুন, অবরুদ্ধতা, নিপীড়ন, ধর্মান্ধতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বে সব তরুণই উচ্চকিত। তরুণরা স্বপ্ন দেখে নতুনত্বকে জয় করবার।
বিশ্বে ১২০ কোটি তরুণ ভোটার রয়েছে। অথচ এই তরুণদের মধ্যে জনপ্রতিনিধিত্বের হার ২ ভাগেরও কম। রাজনীতিতে তরুণদের আগ্রহ দিন দিন কমছে। আর এর প্রধান কারণ হলো আদর্শহীন ও মিথ্যা রাজনীতি বলে জানান আইপিইউয়ের ফোরাম অব ইয়ং পার্লামেন্টারিয়ানসের প্রেসিডেন্ট অসুরো মাওরিনে (২৬)। তিনি আরো বলেন, রাজনীতিকরা মিথ্যা প্রতিশ্রæতি দেন, মিথ্যা কথা বলেন কিন্তু তরুণদের মেধার কোনো দাম দেন না। ১৮ বছর বয়সের একজন তরুণ অপরাধ করছে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে তাদের শাস্তি হয় কিন্তু তাদের নেতৃত্বে আনা হয় কত জনকে? মাওরিন আরো বলেন, তরুণদের মধ্যে আবার নারীরা নেতৃত্বের ক্ষেত্রে আরো পিছিয়ে কারণ সারা বিশ্বের পুরুষরা মনেই করে নারীরা ঘরের কাজ করবে আর তাই তাদের শিক্ষা দেয়া হয় না, যার ফলে তারা পিছিয়ে পড়ে সব ক্ষেত্র থেকে।
বাংলাদেশের পার্লামেন্ট থেকে দলীয় পদ ও মর্যাদার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই এখানে তরুণদের ভোট ব্যাংক হিসেবেই কেবল বিবেচনা করা হয়। এই তরুণদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার জন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোতে কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা দেখা যায় না। ছাত্র সংগঠনগুলোকেও লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে বা ক্ষমতা দখলের যন্ত্র হিসেবেই তারা ব্যবহার করে। অন্যদিকে ছোট ছোট দলগুলোতেও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে তরুণদের খুব কমই দেখা যায়। অপেক্ষাকৃত বামপন্থি দলগুলোতে তরুণ কর্মীদের দেখা গেলেও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সেখানেও খুব ব্যতিক্রমী কিছু দেখা যায় না। বাংলাদেশে ২৪ বছর বা তার নিচের বয়সের মানুষের পরিমাণ ৪৯ শতাংশ। আর কর্মক্ষম মানুষ আছে ১০ কোটি ৫৬ লাখ। এই কর্মক্ষম মানুষের একটি প্রধান অংশ হলো তরুণ।
আবার শুরু হয়েছে নির্বাচনী ডামাডোল। তরুণদের নিয়ে আবার শুরু হবে নানান কৌশল। হয়তো এই ডামাডোলে প্রাণও ঝরবে অনেকের। কিন্তু এই তরুণদের জন্য কি কোনো আশা জাগানিয়া কিছু হবে? এরই মধ্যে দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে এক অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক এই তরুণদের নিয়ে যারা ব্যবহৃত হচ্ছে ক্ষমতার পথে। অথচ এই তারুণ্য এমন ছিল না।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, নানকার, টংক, তেভাগা, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন, শাহবাগ আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনসহ সব লড়াই সংগ্রামের প্রধান শক্তি ছিল তারুণ্য। বাংলার দামাল তারুণ্যই আমাদের সব অর্জনের প্রধান হাতিয়ার। আজ সেই তারুণ্য অবহেলিত, বঞ্চিত। তরুণদের নিয়ে দৃশ্যমান কোনো পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। রাজনীতিতে এই তারুণ্য প্রধান শক্তি কিন্তু দলে ও রাষ্ট্র, সরকার পরিচালনায় তাদের অংশগ্রহণ খুবই নগণ্য। এই তারুণ্যকে বাদ দিয়ে আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো কি সম্ভব?
ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল : সম্পাদক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন