তরুণদের রাজনৈতিক ভাবনা নিয়ে একটি পত্রিকার করা সমীক্ষায় যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে আশাহত না হলেও একটু খটকা লাগে। কেননা বাংলাদেশের ইতিহাসের পশ্চাতে ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, এ দেশের উন্মেষের মূল শক্তিই ছিল তরুণ সমাজ। আজকের যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, তার উত্থান একাত্তরে হলেও এর মূল বীজ রোপিত হয়েছিল বায়ান্নতে। কিন্তু এই বায়ান্ন’র ভেতরে কাদের কথা সুরমূর্ছনায় উঠে আসে? নিশ্চিতভাবেই এ দেশের বুকে আঠারো-উত্তীর্ণ যুবকদের কথা। কেননা কুচক্রীদের প্রতিটি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল এ দেশের তরুণসমাজ অসীম তেজ ও দুর্বার বেগে। তাদের প্রাণচাঞ্চল্যতা ও দেশমাতৃকার জন্য অকৃত্রিম দরদবোধের জন্যই তারা বাংলাকে রক্ষার মহান ব্রত নিয়েছিল। এরপর চুয়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তর ও একাত্তরে চূড়ান্তভাবে অংশগ্রহণ ও দুর্বার প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে এ দেশের আকাশে সোনালী সূর্য উদিত হয়।
কিন্তু সমসাময়িক বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তরুণদের সিংহভাগের যে অনাগ্রহ—তাতে কিছু জোরালো কারণ তো অবশ্যই আছে। এ কারণ অনুধাবনের জন্য সামপ্রতিক সময়ে সংঘটিত কিছু ঘটনা উল্লেখ করলেই যথেষ্ট হবে। দিন তিনেক আগে দেশের প্রায় সব পত্রিকার শিরোনামে ছিল সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগের গ্রুপভিত্তিক সংঘর্ষ। এই কোন্দলের রোষানলে পড়ে প্রাণ হারাতে হয়েছে খালেদ আহমেদ লিটু নামে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে। হয়ত ছাত্রলীগের সুদিন ফিরবে, একসময় স্থিতিশীল অবস্থায় বিরাজ করবে তারা। কিন্তু খালেদ তো আর মায়ের কোলে কোনোদিন ফিরবে না। তার মায়ের ভিতরে ছেলেকে হারানোর এক শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা কি কখনো পূরণ হবে? নিজের কাঁধে ছেলের লাশ বহন করাটা তার পিতার জন্য কতটা মর্মান্তিক সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কে বুঝবে? তার অকালে প্রয়াণ তাও তো গর্বের না। না এটা ছাত্রলীগের গর্ব, না তার পরিবারের। আবার চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও আরো দুই একটি স্থানে সেই ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দল। আচ্ছা, যে ছাত্র সংগঠন উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনন্য নাম, যার প্রতিষ্ঠা হয়েছে বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চ কাঁপানো নেতা ও বাংলার অসহায় মানুষের বিশ্বস্ত ব্যক্তিত্ব জাতির জনকের হাতে—আমরা, আমাদের প্রজন্ম কি এ কোন্দল প্রত্যাশা করি?
কিন্তু এ জঘন্য কর্মকাণ্ড তো শুধু উল্লিখিত সংগঠনের একার নয়, ছাত্রদল বা এরকম অন্যান্য যে ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠন আছে—তারা কি আদর্শ পথে আছে? বৃহত্ ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বৈরিতা যেমন আছে তেমনি নিজেদের মাঝে ও বৈরিতার চর্চা হয়। তবে যে দল ক্ষমতায় থাকে সে দলের আওতাধীন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে অর্থাত্ নিজেদের মাঝে কলহ বেশি। এখন প্রশ্ন হলো ক্ষমতাসীনদের তো অতৃপ্তি নেই। তাদের তো ফেয়ার বা স্থিতিশীল গণতন্ত্র চর্চা করার কথা। এ নামমাত্র ধারণা ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর চিন্তা ও স্বপ্নকে কলুষিত করে। কেননা সবার বিশ্বাসে এটা ভালোভাবে বদ্ধমূল হয় যে, ভালো মানুষ হয়ে লাভ নেই বা সমসাময়িক সমাজে নৈতিকতার শিক্ষারও কোনো দাম নেই। আবার যারা প্রবল আগ্রহী রাজনীতিতে, তারা সুস্থ ধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয় বা চর্চা করতে আগ্রহী না। এর বিশেষ কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশে তরুণ থেকে শুরু করে প্রবীণ পর্যন্ত মেধাবী ও সত্ ব্যক্তিকে রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা করতে অনিচ্ছুক। যার দরুন এ জায়গাগুলো দখল করে অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত বা ঝরে পড়ার মতো কিছু নামমাত্র শিক্ষার্থী। এদের রাজনৈতিক জ্ঞানের স্বল্পতা ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে কমপারেটিভ পলিটিক্স চর্চা নিয়ে অনাগ্রহ বা জানা না থাকায় রাজনীতিতে স্থিতিশীল অবস্থার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এ সব অযোগ্য তরুণদের দ্বারাই মূলত বিশৃঙ্খলা বেশি হয়। অর্থাত্ কিছু তরুণ সুস্থ ধারার রাজনৈতিক চর্চা করলেও এরা ওদের টিকে থাকতে দেয় না। এসব ছাত্রনেতা নামধারী ক্যাডাররা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের সিট বণ্টনে একচ্ছত্র অধিকার চর্চা করার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের অধিকার ও দায়িত্ব নস্যাত্ করে। আর এখানে পারস্পরিক মতের অনৈক্যতার জন্য সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ জন্যই দেখা যায়, প্রায় কিছুদিন পরপর কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে অবরোধ করার মতো জঘন্য চিত্র। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ছায়াতলে থাকায় এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দুঃসাহস কারো হয় না।
কিন্তু এ সব সমস্যা উপড়ে ফেলতে রাজনীতিতে যদি মেধাবী তরুণদের সম্পৃক্ততা না ঘটে তাহলে সুস্থ ধারার রাজনৈতিক চর্চা কস্মিনকালেও হবে না এবং এ দেশ স্বার্থান্বেষীদের স্বার্থ হাসিলের আঁতুড় ঘরে পরিণত হবে। তাই আমাদের সকলের প্রত্যাশা রাজনীতিতে সত্, তরুণ নেতৃত্বের সুদিন ফিরুক।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন