হ্যান্ডবল, ভলিবলসহ অন্যান্য খেলাধুলায় স্থানীয় পর্যায়, জেলা পর্যায়, বিভাগীয় পর্যায়, জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ঐতিহাসিক অনেক অর্জন ও প্রাপ্তির পেছনে দিনরাত অক্লান্ত শ্রম করেছেন, অর্থ ব্যয় করেছেন, শিক্ষার্থীদের ভালো খেলোয়াড় হিসেবে স্বপ্ন দেখিয়েছেন এবং শতশত মানুষের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন আবুল হোসেন। তার পাঠশালায় গড়ে ওঠা মেয়েরা আজ শুধু স্থানীয়ভাবে নয়, দেশে পেরিয়ে বিদেশেও সেরা। আড়ালে আবডালে থাকা প্রচারবিমুখ এই গুণী মানুষটি সম্পর্কে দেশের অধিকাংশ মানুষই অচেনা। নাছোড়বান্দা এই মানুষটির স্নেহ, মায়া, মমতায় যেসব মহিলা হ্যান্ডবল খেলোয়াড় গড়ে উঠেছে আজ তাদের ও তাদের পরিবারের অনেকেরই জীবন বদলে গেছে। জাতীয় দলসহ বিভিন্ন সার্ভিসেস টিমে খেলে ও চাকরির সুবাদে অনেকেই আজ প্রতিষ্ঠিত। দিনমজুর, পাথর শ্রমিক, বর্গাচাষি বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দরিদ্র অসহায় পরিবারের এই মেয়েরা আজ স্বাবলম্বী। স্কুলের মেয়েদের খেলাধুলায় আনা, হাপপ্যান্ট পরে মেয়েদের হ্যান্ডবল খেলানো এক সময় চিন্তাও করা যেত না। সেই অবাস্তবকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন আবুল হোসেন স্যার। সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক বাঁধা উপেক্ষা করে তেঁতুলিয়ার মতো অনুন্নত এলাকায় নারী খেলোয়াড় সৃষ্টিতে বিস্মিত করেছেন সবাইকে।
বন্ধু মাঠে মিশন শুরু
স্কুল ছুটির পর স্কুলের পাশে আম বাগানের বন্ধুর একখণ্ড মাঠে শুরু হতো মেয়েদের নিয়ে কঠোর অনুশীলন। মেয়েরা দুয়েকবার বল ছুঁড়লেই তিনি বুঝতে পারতেন তাকে দিয়ে হ্যান্ডবল খেলা হবে। এমন করে খুঁজে খুঁজে গড়ে তোলেন মহিলা হ্যান্ডবল দল। শুরু করেন স্কুলের মেয়েদের হ্যান্ডবল খেলার প্রশিক্ষণ দিতে। প্রথম প্রথম পরাজিত হলেও মনোবল ভেঙে যায়নি, দৃপ্ত পথে এগিয়ে গেছেন। অবশেষে বিজয় ও সফলতা হাতের মুঠোয় এলো। শুধু তেঁতুলিয়া নয়, পঞ্চগড় জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে এখানকার মেয়েরা সগৌরবে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। জাতীয় পর্যায়ে তো বটেই, এখানকার মেয়েরা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পরিচিত করেছে। বর্তমানে জাতীয় হ্যান্ডবল দল, বিজেএমসি, আনসার ও পুলিশ বাহিনীসহ দেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন দলে শতাধিক খেলোয়াড় স্থান করে নিয়েছেন। তার আশির্বাদেই কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজের এ প্রতিষ্ঠানটির করুণদশা হলেও হ্যান্ডবল, ভলিবল, কাবাডি, ফুটবল, ক্রিকেট, সাইক্লিং, তায়াকান্দো, উশু, শুটিংসহ সব খেলাতেই এর মেয়েরা বেশ পারদর্শী। দেশের সর্ব উত্তরের তেঁতুলিয়া উপজেলার অসচ্ছল দরিদ্র পরিবারের সন্তান রওশন আক্তার বুলু, শাহীদা খাতুন, রোকসানা আক্তার, মালেকা বেগম, শিল্পী আক্তার, ঝর্ণা আক্তার, রাজিয়া সুলতানা, শিউলি পারভীন, সুমি আক্তার, সুশিলা, তৃপ্তি, হাবিবা আক্তার রূপা, শিরিনা আক্তার, শাহিনা আক্তার, ফাতেমা খাতুন, নিশি, ময়না, রুবিনা আক্তার, রহিমা খাতুন, কহিনুর আক্তার, মাসুদা বেগম, হোসনে আরা পারভীন, শিফা আক্তার, শারমীন আক্তার রুমি, নাজিরা খাতুনরা নিজ নিজ খেলায় আজ প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক ও উন্নতমানের প্রশিক্ষণের অভাব, মাঠের সমস্যা, ক্রীড়া সরঞ্জামাদির সঙ্কটসহ দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় অভাব-অনটনও ভালো খেলোয়াড় গড়ে উঠতে প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন তেঁতুলিয়ার মহানন্দা পাড়ের নারী খেলোয়াড়রা।
শূন্য থেকে শুরু
মো. আবুল হোসেন মণ্ডল ১৯৬৩ সালে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে চলে আসেন তেঁতুলিয়ায়। ৯ বছর বয়সে তেঁতুলিয়া পুরাতন বাজারে তার পিতার মিষ্টির দোকানে কাজ করতেন। তেঁতুলিয়া এলাকার ভেন্ডার ও লাইব্রেরিয়ান আব্দুল হাকিম সিদ্দিকীর কথায় মিষ্টির দোকানের কাজ বাদ দিয়ে তিনি তেঁতুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। মিষ্টির দোকানে কাজের পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। ৫ম শ্রেণি পাস করার পর মায়ের অনুরোধে তেঁতুলিয়া থেকে আবার ময়মনসিংহের বিদ্যাগঞ্জে ফিরে যান। তিনি ১৯৭০ সালে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।
তারপরের গল্পটা শুনলাম আবুল মাস্টারের মুখেই—দেশে যুদ্ধ শুরু হলে অনেকের মতো আমিও যুদ্ধে গেলাম। যুদ্ধ করলাম। দেশ স্বাধীন হলে আমি আমার স্থানে ফিরে এলাম। ১৯৮৩ সালে কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজে গণিত বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। ছোটবেলা থেকে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ও ফুটবলের প্রতি আসক্ত ছিলাম। স্কুলে যোগদানের পর মেয়েদের খেলাধুলার বিষয়টি আমার মাথায় আসে। যেহেতু আমি নিজেই খেলোয়াড় ছিলাম, সেকারণে আগ্রহটা আমার বেশি ছিল। সেসময় আন্তঃস্কুল মাদ্রাসা পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় হ্যান্ডবল খেলা প্রথম শুরু হচ্ছিল। আমার অবশ্য হ্যান্ডবল সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। আমাদের এলাকার দু’জন বিজিবি সদস্য রুহুল আমিন হায়দার ও আবুল কালাম আজাদ ভাই হ্যান্ডবল খেলতেন। তারা বাড়ি আসার পর মেয়েদের হ্যান্ডবল প্রশিক্ষণ দিতেন। তখন আমি হ্যান্ডবল খেলার কলাকৌশল, নিয়মকানুনগুলো ভালো করে আয়ত্ত্ব করতাম। তারা চলে গেলে আমি মেয়েদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিই। প্রশিক্ষক হিসেবে নিজের স্কুলসহ আশেপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেয়েদের হ্যান্ডবল খেলায় উত্সাহিত করি। মেয়েদের বাসায় বাসায় গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে মহিলা হ্যান্ডবল ও ভলিবল খেলোয়াড় তৈরির জন্য লড়াই শুরু করি। এভাবে একদিন পুরো হ্যান্ডবল ও ভলিবল টিম গঠন হয়। মাঠ নেই, খেলোয়াড় ও খেলার সরঞ্জামাদি নেই, এরমধ্যেই সকলকে একসঙ্গে নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। আমরা বিভিন্ন খেলায় অংশ নেওয়া শুরু করি। প্রথমদিকে জেলা পর্যায়ে আমরা দু-বার হেরে যাই। রংপুর উপ-অঞ্চলেও ৪/৫ বার হেরে যাই। কিন্তু আমরা কেউই মনোবল হারাইনি। অবশেষে নিবিড় তত্ত্বাবধানে ২০০০ সালে জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হ্যান্ডবলে রংপুর উপ-অঞ্চলে চ্যাম্পিয়ন হই। একই বছর জাতীয় মহিলা ভলিবল প্রতিযোগিতায়ও চ্যাম্পিয়ন হয় পঞ্চগড় জেলা দল।
অসামান্য অর্জন
এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাদের। ২০০৫ সালে অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় মহিলা হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতা ও জাতীয় মহিলা হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় পঞ্চগড় জেলা দল। ২০০৬ সালের জাতীয় মহিলা হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় আবারো চ্যাম্পিয়ন হয় পঞ্চগড় জেলা দল। একবার দু-বার নয়, জাতীয় পর্যায়ে হ্যান্ডবলে ৯ বার চ্যাম্পিয়ন হয় পঞ্চগড় জেলা দল। জাতীয় পর্যায়ে ভলিবলে দু-বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। অসংখ্যবার রানার্সআপ হয়েছে তারা। ২০১১ সালে কলকাতায় ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত হ্যান্ডবলের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়। সেখানে বাংলাদেশের ১৪ জনের দলের মধ্যে ১১ জন খেলোয়াড়ই ছিল তেঁতুলিয়া কাজী শাহাবুদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মেয়ে। পঞ্চগড় জেলা মহিলা হ্যান্ডবল ও ভলিবল দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ই তার একান্ত প্রশিক্ষণের ফসল। এ পর্যন্ত তার তৈরি ১০/১২ জন খেলোয়াড় জাতীয় হ্যান্ডবল দলের হয়ে দেশ-বিদেশের মাটিতে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বতমানে বিজেএমসি, আনসার, পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন সার্ভিসেস টিমের হয়ে খেলছেন তারই হাতেগড়া ৫০/৬০ জন খেলোয়াড়।
সবার পাশে সবসময়
ক্রীড়া শিক্ষক আবুল হোসেন ভলিবল, ব্যাডমিন্টন খেলেছেন, ছিলেন ফুটবলের রেফারি। স্কুলের মেয়েদের হ্যান্ডবল নিয়ে মাতামাতিতে মূল উত্সাহ তারই। হ্যান্ডবল খুব সহজ খেলা। তাছাড়া বাড়তি খরচও খুব বেশি নেই। আবুল হোসেন ছোটবেলা থেকেই অভাব অনটনের সংসারে বড় হয়েছেন। তেঁতুলিয়ার এই গরিব মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়তো। এ কারণে তাদের যোগ্য ও দক্ষ খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। খেলোয়াড় তৈরি ও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিজ স্কুলের পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্কুলের মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলতে উত্সাহিত করতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের ও তাদের পরিবারের অভিভাবকদের বুঝিয়ে মাঠের প্রশিক্ষণে নিয়ে আসতেন। যাতায়াতের জন্য গাড়ি ভাড়া দিতেন, টিফিন খাওয়াতেন, মাঝে মাঝে হাত খরচ দিতেন, অসুখ-বিসুখ হলে নিজের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ দিতেন। পরিবারের সদস্যদেরও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করতেন। সাবিনা নামের এক খেলোয়াড়কে তো নিজের মেয়ের বাইসাইকেলও দিয়ে দিয়েছিলেন। হ্যান্ডবল খেলোয়াড় শাহীদা খাতুন, ঝর্ণা ও সুলতানা রাজিয়া বলেন, ‘আবুল স্যারের কল্যাণে ও অনুপ্রেরণায় আজ আমরা হ্যান্ডবলে প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়। ভবিষ্যতে আরো ভালো হ্যান্ডবল খেলে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই।’ আনসার বাহিনীর ক্যাপ্টেন ইসমত আরা নিশি জাতীয় পর্যায়ে খেলতে পারার জন্য আবুল তার কাছে কৃতজ্ঞ। আজ যতটুকু সুনাম অর্জিত হয়েছে তার পুরোটাই আবুল স্যারের।
স্যার আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন
জাতীয় দলের সদস্য সুমি বেগম বলেন, ‘হ্যান্ডবল আমার নেশা ও পেশা। আমার পরিবারে বাবা ছাড়া কেউ চাইতেন না আমি খেলাধুলা করি। এখন দেখে যে, আমি ন্যাশনাল টিমে খেলছি, আমার সুনাম হচ্ছে, পরিবারের সুনাম হচ্ছে, এমনকি আমার জেলার সুনাম হচ্ছে, দেশের সুনাম হচ্ছে, এখন তারা বিষয়টি বুঝছে। আমি বেস্ট প্লেয়ার হয়েছিলাম। খেলতে পারছি, সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি, নিজেকে ধন্য মনে হয়। শ্রদ্ধেয় আবুল হোসেন স্যারের জন্য আজ এ পর্যন্ত পৌঁছেছি। স্যার আমাদের অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এখন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে। স্যারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’
শিক্ষক আবুল হোসেন মণ্ডল ২০১৪ সালে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু এখন অবধি তিনি মেয়েদের প্রশিক্ষণ না দিয়ে থাকতে পারেন না। ছাড়তে পারেন না খেলার মাঠ। মাঠই যেন তার প্রাণ। মাঝে মধ্যে বিদ্যালয়ের পাশের সেই মাঠে গিয়ে বর্তমান প্রশিক্ষণ আব্দুস সালামকে সহযোগিতা করেন। খেলাটা তার রক্তের ভেতরে এমন করে মিশে গেছে যে, অবসর নিলেও স্কুলে না গিয়ে থাকতে পারেন না। আল্লাহ যেন তাকে আমৃত্যু এভাবে মেয়েদের খেলাধুলার প্রশিক্ষণ দিয়ে যেতে পারেন সেই ইচ্ছাই পোষণ করেন। কিংবদন্তী আবুল হোসেন বেঁচে থাকুক সকলের মাঝে। সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন