১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবার এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো, ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন’।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যায় মারা যায়। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন (প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন)। বাংলাদেশে আত্মহত্যার জাতীয় কোনো পরিসংখ্যান নেই। স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, এ হার প্রতি লাখে ১০ জন, যা উন্নত দেশের কাছাকাছি। প্রতিটি আত্মহত্যা ঘটানোর আগে গড়ে ২৫ বার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। এ জন্য আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আর অগণিত জীবনহানি প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা, দ্রুত ও সময়মতো আত্মহত্যার প্রবণতা নির্ণয় ও তার প্রতিকার, চিকিৎসা ইত্যাদি।
কারণ
আত্মহত্যা বা আত্মহনন অমূল্য জীবনের অপচয়। তবু মানুষ আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়। নানা গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যাকারীদের ৯০ শতাংশেরই কোনো না কোনো ধরনের মানসিক রোগের সমস্যা ছিল। এর মধ্যে ডিপ্রেশন, স্কিটজোফ্রিনিয়া নামের জটিল মানসিক রোগসহ মাদকাসক্তি ও অ্যালকোহলে আসক্তি, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, মৃগী রোগের মতো শারীরিক কারণে মানসিক সমস্যা ইত্যাদি অন্যতম।
আত্মহত্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী যে মানসিক রোগ, তার নাম ‘ডিপ্রেশন’। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সব কিছু (নিজের, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ) নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখেন। তিনি সব সময় মনে করেন, এ অবস্থা থেকে তার আর পরিত্রাণ নেই। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বিষণ্নতার হার ৪.৬ শতাংশ। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে মানসিক রোগ দ্বিগুণ এবং বিষণ্নতার হার আগের তুলনায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ছাড়াও আত্মহত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের সমস্যা অনেকাংশে দায়ী।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, অপ্রাপ্তি, অসহ্য মানসিক চাপ, মানসিক ও যৌন হয়রানি, সহিংসতা, যৌতুকের চাপ, পরকীয়া, প্রেম, দাম্পত্যকলহ প্রভৃতি থেকে সাময়িক নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বিষয়টির সঙ্গে মানসিক চাপ মোকাবেলার দক্ষতার অভাব ও ব্যক্তিত্বের ভঙ্গুরতা সম্পর্কযুক্ত। তার ওপর যখন শেষ আশ্রয়স্থল ঘনিষ্ঠজন ও পরিবারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হন, তখন ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। এ জন্য মানসিক চাপ মোকাবেলার দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা অর্জন আত্মহত্যা প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে।
আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মিডিয়ার দায়িত্বহীন রিপোর্টিংকেও অনেক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানী দায়ী করেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, টিভিতে আত্মহত্যার দৃশ্য ও সংবাদ প্রকাশের ১০ দিন পর্যন্ত আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। ১৭৭৮ সালে জার্মান ঔপন্যাসিক গ্যাটের Sorrows of Young Werther উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়, এরপর বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। এ ঘটনা থেকে Werther Effect শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ—‘আত্মহত্যার ছবি ও পদ্ধতি অনুকরণ করে আত্মহত্যা।’
চিকিৎসা
ডিপ্রেশন, স্কিটজোফ্রিনিয়া, মাদকাসক্তি ও অ্যালকোহলে আসক্তি, ব্যক্তিত্বের সমস্যা, মৃগী রোগ ইত্যাদি মানসিক রোগের বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিকিৎসা দেশেই বিদ্যমান। মানসিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে মানুষের আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তীব্র থেকে মাঝারি ধরনের বিষণ্নতায় মস্তিষ্কের রাসায়নিকের তারতম্য দেখা যায় বলে ওষুধের প্রয়োজন হয়। আবার মৃদু ও মাঝারি ধরনের বিষণ্নতায় সাইকোথেরাপি বেশ কার্যকর। এ জন্য মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে ও মনোবিজ্ঞানীর সহযোগিতা নিতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবারের জোরালো ভূমিকা থাকা উচিত।
আত্মহত্য প্রতিরোধে করণীয়
আত্মহত্যা সম্পন্ন হয়ে গেলে যেহেতু কিছুই আর করার থাকে না, এ জন্য প্রতিরোধই একমাত্র কার্যকর পন্থা। এ ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে তা হলো—
► আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
► মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীর সহায়তা নিতে হবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি চালু করতে হবে।
► আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকারী ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখা, তাদের কথা মনোযোগের সঙ্গে শোনা ও তাদের পাশে দাঁড়ানো সবার নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব।
► আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকারীর সব সময় নিজেকে মেরে ফেলার ইচ্ছা না-ও থাকতে পারে। আবার আত্মহত্যার প্রচেষ্টায় অসফল ব্যক্তি তার ইচ্ছার কথা গোপনও করতে পারে। এ জন্য আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে সব সময় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এর মানসিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ ও সমস্যা নিরূপণ করে সময়মতো চিকিৎসা প্রদান করতে হবে।
► বাংলাদেশে, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে কীটনাশক বা বিষ পান করে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। এ জন্য কীটনাশক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ, সচেতনতা ও সতর্কতা বৃদ্ধি এবং কীটনাশকের বিষাক্ততার মাত্রা মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শ্রীলঙ্কায় কীটনাশকের ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে ১৯৯৫-২০০৫—এই এক দশকে আত্মহত্যার হার অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
► মিডিয়ায় আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে আরো সতর্কতা অবলম্বন করে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এরই মধ্যে মিডিয়ায় আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে বিশেষ গাইডলাইন প্রণয়ন করেছে। এটি অনুসরণ করায় হংকংয়ে আত্মহত্যার হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ নীতিমালায় আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে নাটকীয়তা পরিহার, হেডলাইন ও কাভার পেজে সংবাদ না ছাপা, ব্যক্তির ছবি পরিহার, বিখ্যাত ব্যক্তির ক্ষেত্রে আত্মহত্যার খবর মৃত্যু সংবাদ হিসেবে দেওয়া, মানসিক ও শারীরিক কারণে আত্মহত্যা করে থাকলে সেটি উল্লেখ করা ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ রয়েছে। গণমাধ্যম ব্যবস্থাপকদের উচিত, এসব বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং সাংবাদিকতার নীতিমালায় আত্মহত্যার সংবাদ পরিবেশনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা, যা আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
► সর্বোপরি আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে এ ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। সূত্র: দৈনিক কালের কণ্ঠ
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন