১৯৯৮ সাল। হাতে তৈরি কাগজ বা হ্যান্ডমেড পেপারের তৈরি বিভিন্ন ধরনের কার্ড নিয়ে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় (অ্যাম্বিয়েন্ট) অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের এক তরুণ উদ্যোক্তা। প্রথম দুই দিন কয়েকজন ক্রেতা কার্ডগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেও খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না। তৃতীয় দিনে নরওয়ের দুই ব্যবসায়ী এলেন। কার্ড দেখে বললেন, ‘তোমার পণ্যের দাম অনেক বেশি। থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা আরও কম দামে দিচ্ছে।’
ক্রেতাদের কথা শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন সেই তরুণ। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘আমি তো ব্যবসায়ে নতুন। অন্যদের দামের বিষয়ে আমার ধারণা নেই। তোমরা নিতে চাইলে আমি থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের দামেই দেব।’ তাঁর সহজ-সরল কথায় নরওয়ের দুই ব্যবসায়ীর মন গলল। তাঁরা ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের এক লাখ গ্রিটিংস কার্ডের ক্রয়াদেশ দিলেন।
২১ বছর আগে এভাবেই হস্তশিল্প পণ্য রপ্তানি শুরু করেছিলেন মো. রাশেদুল করিম মুন্না। বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় হস্তশিল্প পণ্য রপ্তানিকারকদের একটি তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠান ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বহুমুখী পাটপণ্যকে নিয়ে গেছে নতুন এক উচ্চতায়।
ক্রিয়েশন কাঁচা পাট, পাটের সুতা ও কাপড় হোগলা, চামড়া, কলাগাছের বাকল, কচুরিপানাসহ বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে নান্দনিক নকশায় গৃহস্থালি, নিত্যপ্রয়োজনীয়, বাসাবাড়িতে বাগান করার সরঞ্জাম, ফ্লোর কাভার, প্যাকেজিং বা মোড়কীকরণ পণ্য, সাজসজ্জার উপকরণ, অফিসের ব্যবহার্য প্রায় ১২ হাজার হস্তজাত পণ্য প্রস্তুত ও রপ্তানি করে। সর্বশেষ গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৪৫ লাখ ডলারের হস্তশিল্প রপ্তানি করেছে ক্রিয়েশন। সেই পণ্য জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ বিশ্বের ৩৯ দেশে রপ্তানি হয়েছে।
বর্তমানে ক্রিয়েশনের কারখানার সংখ্যা তিনটি—গাজীপুরের টঙ্গী ও পুবাইল এবং নরসিংদীর শিবপুরে। সেখানে কাজ করেন ৭২৫ জন। গাজীপুরের কালীগঞ্জে পাটপণ্য, মানিকগঞ্জের ঝিটকায় মাছের জাল ও হরিরামপুরে বেতের পণ্য, যশোর ও বাগেরহাটে নারকেলের ছোবড়া ও খোসার পণ্য, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি ও নরসিংদীর শিবপুরে পাটপণ্য তৈরি করায় ক্রিয়েশন। এই সাত ক্লাস্টারে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করেন ৩ হাজার শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়েছে। পাট উৎপাদনের নকশা ও কাঁচামাল সরবরাহ করে ক্রিয়েশন।
ফ্রাঙ্কফুর্টের মেলায় প্রথম রপ্তানি আদেশ পেলেও রাশেদুল করিমের ব্যবসায়ী হওয়ার পেছনে আরও গল্প আছে। গত সপ্তাহে উত্তরার কার্যালয়ে সেই গল্প শোনালেন তিনি। তখন বাইরে তুমুল বৃষ্টি। রাশেদুল করিম একেবারে শুরু থেকেই শুরু করলেন।
সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে জন্ম হলেও বড় হয়েছেন রাজধানীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স শেষ করে বেসরকারি একটি সংস্থায় চাকরি নেন রাশেদুল করিম। ১৯৯৪ সাল থেকে সেই সংস্থার হয়ে কাজ করার সময় ৫৫ জেলায় ঘোরেন। তখন প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, তাঁরা অনেক বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদন করলেও তাঁদের ব্যবসা বড় হচ্ছে না। উল্টো বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে তাঁরা ঋণের জালে জড়িয়ে যান। তাঁদের জন্য কিছু করার চিন্তা থেকেই ১৯৯৬ সালে হুট করে চাকরি ছেড়ে দিলেন তিনি।
রাশেদুল করিম বললেন, ‘নান্দনিক হস্তশিল্প তৈরি করেন বিভিন্ন জেলার প্রান্তিক উদ্যোক্তারা। আমার কাছে মনে হয়েছে, তাঁদের সহায়তা করতে চাইলে সরবরাহব্যবস্থায় কিছু একটা করতে হবে। যাতে তাঁরা তাঁদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান। সেটি হলেই তাঁদের ভিত শক্ত হবে।’
১৯৯৭ সালে মাত্র ৫ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে হাতে তৈরি কাগজ বা হ্যান্ডমেড পেপারের ব্যবসায় নামেন রাশেদুল করিম। ফেনীতে আরেক ব্যবসায়ীকে নিয়ে পুরোনো একটি কাগজের মিল কিনে নেন। হাতে তৈরি কাগজের কী ধরনের পণ্য বিদেশিরা কেনেন, সেটি দেখতে ফ্রাঙ্কফুর্টের মেলায় যান। পরের বছর সেই মেলাতেই প্রথম হাতে তৈরি কাগজের কার্ডের রপ্তানি ক্রয়াদেশ পান। নরওয়ের সেই ক্রেতাকে টানা ৭ বছর কাগজের কার্ড সরবরাহ করেন তিনি। মাসে ২০ হাজার।
পাট দিয়ে তৈরি কাগজ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে রাশেদুলের মাথায় ঘুরতে থাকে, আরও কী করা যায়। সঙ্গে প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের বিষয়টি তো ছিলই। কাঁচামালের সহজলভ্যতা, পরিবেশবান্ধব ও সম্ভাবনাময় বাজারের কারণে শেষ পর্যন্ত বহুমুখী পাটপণ্য নিয়ে মনোযোগী হলেন। বিদেশের মেলায় ঘুরে দেখলেন পাটের কোন ধরনের পণ্যের চাহিদা আছে। তারপর দেশের ১৪টি পাটকল ঘুরলেন, কোথায় কী ধরনের পণ্য তৈরি হচ্ছে, তা দেখলেন। গাজীপুরের কালীগঞ্জে স্থানীয় শ্রমিকদের সঙ্গে পণ্য তৈরির বিষয়ে কথা বললেন।
তখনো কারখানা করতে পারেননি রাশেদুল। এক বন্ধুর বায়িং হাউস থেকে পাটের কিছু পণ্য তৈরি করে ১৯৯৯ সালে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের এক মেলায় অংশ নেন। সেখানে জাপানের এক ক্রেতার কাছ থেকে ১৩ হাজার ৫০০ পাটের ব্যাগের ক্রয়াদেশ পান। সেই ব্যাগ পুরান ঢাকার বংশালের ৬-৭টি ছোট কারখানা দিয়ে করালেন। পরের বছরই টঙ্গীতে কারখানা করেন। তখন সেখানে কাজ করেন ৩৫-৪০ জন শ্রমিক। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি রাশেদুলকে। গত দেড় দশকে ব্যবসা বাড়িয়েছেন কয়েক গুণ।
পুবাইলে নতুন কারখানা করেছেন রাশেদুল। সেখানে পণ্য তৈরির পাশাপাশি পাটের কাপড় (জুট ফেব্রিকস) উৎপাদনের পরিকল্পনা করছেন। বর্তমানে তাঁর ধ্যানজ্ঞান বহুমুখী পাটপণ্যের রপ্তানিকে কীভাবে আরও শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায়। কীভাবে অন্য উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা যায়। তিনি বললেন, ‘দেশে পাটকলগুলোতে ৫-৬ রকমের ফেব্রিকস তৈরি হয়। কিন্তু বৈচিত্র্যময় আরও অনেক ধরনের কাপড় দরকার। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই প্রায় ১০৭ রকমের কাপড় তৈরি হয়। সে জন্যই উদ্যোগটি নিয়েছি।’
বহুমুখী পাটপণ্যের বাজারে শক্ত অবস্থান গড়ার পেছনের মূলমন্ত্র কী? জবাবে রাশেদুল করিম বললেন, ‘প্রতিযোগী দেশের উদ্যোক্তারা কী ধরনের পণ্য উৎপাদন করছে, সেটি জানতে আমি বিদেশের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে যাই। সেখানে ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের চাহিদাও বুঝিতে পারি। সে অনুযায়ী, আমরা প্রতিনিয়ত গবেষণা করে পণ্যের মানোন্নয়ন করছি।’
২১ বছরের যাত্রায় বেশ কিছু সাফল্য জমা পড়েছে রাশেদুল করিমের ভান্ডারে। ১৯৯৮ সালে স্পেনের তৎকালীন রানি ডোনা সোফিয়াকে ১২ হাজার নোটবুক সরবরাহ করেন তিনি। সেই নোটবুক বিভিন্নজনকে উপহার দিয়েছিলেন রানি। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত চালর্স ফাউন্ডেশনের ব্র্যান্ড ট্যারাসেন গার্ডেনের বিক্রয়কেন্দ্রে ক্রিয়েশনের পণ্য বিক্রি হয়। ২০১২ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ১০ হাজার ৫০০ পাটের বিশেষ ব্যাগ সরবরাহ করে ক্রিয়েশন। গত কয়েক বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় পাট দিবসের অনুষ্ঠানে যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করেন, সেটিও ক্রিয়েশন তৈরি করে। এ ছাড়া শ্রেষ্ঠ বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারকসহ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছে ক্রিয়েশন।
স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে রাশেদুল করিমের সংসার। স্ত্রী রোবাইয়া ফারহানা অবশ্য ক্রিয়েশনের চেয়ারম্যান। আর তিন সন্তান—আহনাফ ফারহান করিম, সারা সামিয়া করিম ও আহনাফ আবরারুল করিম পড়াশোনা করছে। নিজের ব্যবসা ও পারিবারিক জীবন নিয়ে আত্মতৃপ্তির কথা জানালেন রাশেদুল করিম। বললেন, ‘আমি আমার কাজকে ভীষণ ভালোবাসি। পাট নিয়ে কাজ করতে পেরে আমি মানসিকভাবে তৃপ্ত। কারণ, ব্যবসার পাশাপাশি প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের কিছুটা হলেও কাজ করতে পেরেছি।’ সৌজন্যে- প্রথম আলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন