বিতর্ক আর বিসিএস নিয়ে একসাথে লিখতে বসা –আমার জন্য বিপদজনক। কারণ এই দুয়ের প্রতি আমার অনুভূতি এক নয়। তবু অনেকেরই ভাবনা এমন যে এদের মাঝে খুব একটা সংযোগ রয়েছে তাই অনুরোধে ঢেঁকি গেলা। আরেকটি কারণ এখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের একটি প্রশ্ন বিতর্ক নিয়ে “বিতর্ক করে কি হবে?” –সেটির উত্তর যেকোন ভাবে চাকুরীর সাথে মিলতেই হবে নাহলে আসলে ঠিক উত্তরই হয়না ! সহপাঠ্য কার্যক্রম- এর আসলে সরাসরি কোন অর্থমূল্য হয়না –কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে এটি ছাড়া পাঠ্যপুস্তক আর প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক শিক্ষার একটা বিশাল ফাঁকি থেকে যায়। যার ফলে আমার ছোট্ট কর্মজীবনে দেখেছি যারা আমার সাথে কাজ করছেন তাদের মাঝে যারা শুধুই পড়ালেখা নিয়ে ছিলেন তারা মাঝে মাঝেই হতাশা ব্যক্ত করেন সেটি নিয়ে। তার মানে অবশ্যই এই অভিজ্ঞতা গুলো কোন সনদপত্র ছাড়াই আমাদের এমন কিছু শেখায় যা বাস্তব জীবনে প্রয়োজনীয়।
এবার আসি শুধু বিতর্কের কথা নিয়ে- বিতর্কের জন্য মোটা দাগে কি করতে হয়? প্রথমত একটি বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে হয় বা পড়তে হয়, সেটি নিয়ে চিন্তা করতে হয়- দুই দিকে, এরপর তা উপস্থাপন করতে হয় যুক্তি আর উদাহরণ দিয়ে । এখানে একেবারে বিতর্কের নানা ফরম্যাট বা কঠিন টার্ম বাদ দিয়ে কথা বলছি। বিতর্ক নিয়ে বিশ্লেষন এই লেখার উদ্দেশ্য নয় তাই। আবার বিতর্ক করতে যেয়ে আপনাকে অনেক ভিন্ন মত শুনতে হয় ,সেগুলো কিভাবে ঠিক বা ভুল তা ভাবতে হয় এবং তার বিপরীতে নিজের মত যুক্তি দিয়ে প্রকাশ করতে হয় কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের মাঝে। আরেকটি দিক হল সাংগঠনিক দিক- যেখানে আমরা কোন একটি বিতর্ক ক্লাব এর সদস্য হিসাবে অনেকের সাথে মেশার সুযোগ পাই –সেটিও কিছু নিয়মের মাঝে। এবার একটু ভালভাবে খেয়াল করি বিতর্ক করতে যেয়ে কি কি আলাদা করতে হচ্ছে যা চাকুরী জীবনে সহায়তা করতে পারে বলে সবাই ভাবে-
১। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নির্দিষ্ট পড়ার বাইরে নানা বিষয়ে পড়া
২। বিশ্লেষনমুখী চিন্তা করা
৩। অনেকের সামনে কথা বলার জড়তা কাটানো
৪। নিয়ম(!) মেনে মানুষের সাথে মিশতে শেখা
৫। অনেক বড় একটি নেটওয়ার্ক বা কমিউনিটির সদস্য করা
১ম বিষয়ে অনেকেই বলবেন –আমি তো এমনিই অনেক গল্পের বই পড়ি-হ্যা সেটা পড়ি কিন্তু রাজনীতি,অর্থনীতি,সংস্কৃতি,দর্শন- এসব নিয়ে একটু সিরিয়াস হয়ে খুব কমই পড়ি। আর নিজের পড়ার চাপ এত বেশি থাকে যে চাইলেও হয়না। কিন্তু বিতর্ক আপনাকে বাধ্য করবে এগুলো নিয়ে পড়তে। আর বর্তমানে নিজ বিষয়ের শিক্ষকতা ছাড়া বাংলাদেশের সব চাকুরী একই রকম পরীক্ষা নেয়- সেটা হল আপনি নিজ বিষয় ছাড়া হাবিজাবি(!) কত কি জানেন। তাহলে স্নাতকোত্তর শেষে নতুন করে এসব মুখস্ত করার চেয়ে আগে থেকে পড়াই কি ভাল নয় ?
চিন্তা আমরা সবাই করি কিন্তু একই বিষয়ের দু দিক নিয়ে ভাবা আর তা সম্পর্কে যুক্তি ও উদাহরণ খুঁজে বের করা- সাধারণত তা করা হয়না। কারণ আমরা যেকোন কিছুর এক দিক নিয়েই কথা বলতে ভালবাসি এবং আমি যা বলছি তাই ঠিক ভাবতে আরো বেশি ভালবাসি। বিতর্ক ঠিক এই জায়গাতেই একটা ছোট্ট টোকা দেয়- কেননা এমন হতেই পারে আপনি সাম্যবাদ এর সবগুলো ভাল দিক জানার পরেও কোন এক বিতর্কে এর বিপক্ষেই আপনাকে বলতে হবে! তাই একটা সময় আপনার মগজ এমনভাবেই প্রোগ্রাম হবে যে আপনি যেকোন বিষয় নিয়ে দুই দিকেই চিন্তা করবেন। এখন এটা আপনাকে বিভিন্ন চাকুরীর পরীক্ষায় কিভাবে সহায়তা করবে তা অবশ্য আপনার সিদ্ধান্ত-নিজেই ভেবে নিন।
জড়তা–মঞ্চভীতি-পা কাঁপা; আমি নিজে এই শব্দগুলোর সাথে একেবারেই পরিচিত নই। কারণ ৪ বছর বয়স থেকে আবৃত্তি করা। কিন্তু সবার এটা হয়ে ওঠেনা-তাহলে কি করবেন? বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে বিতর্ক আপনাকে এই সুযোগ দিতে পারে-প্রথমে নিজের হল বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের ছোট্ট রুমের ডায়াসে, এরপর মঞ্চে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিযোগিতায়, তারপর ছোটদের বিচারক (!) হিসাবে……………এভাবে চলতেই থাকে। আপনার জন্য ভাইভা তখন সবরকমের পরীক্ষার মাঝে সবচেয়ে প্রিয় ধরণ হয়ে উঠবে। পারলে ইংরেজী বিতর্কও করার চেষ্টা করুন- দেখবেন কোচিং সেন্টার গুলোকে হাজার টাকা দেবার প্রয়োজন হবেনা ।
শেষ দুইটি বিষয় – নিয়ম আর অনেক বড় কমিউনিটি এটিই হচ্ছে বাস্তব কর্মজীবন। অনেকেই থাকেন যারা খুব সহজে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারেন । কিন্তু অনেকেই পারেন না তাই নতুন কর্মজীবনে নতুন নতুন নিয়ম আর অন্যদের সাথে মেশার ব্যাপারে সমস্যায় পড়েন। বিতর্ক একটি দলগত কাজ। এখানে আপনার একা করার কিছু নেই । আবার একই সাথে এখানে নেতৃত্ব দেয়া বা মানা দু’টোই আপনাকে শিখতে হবে। আপনি নানান মানুষের সাথে মিশবেন এই এক বিতর্কের জন্য-প্রতিনিয়ত শিখবেন কিভাবে মানুষ ভাবে আপনার চেয়ে আলাদা করে কিন্তু সেটাও ঠিক। আর এভাবে নিজেকে প্রশ্ন করবেন, নিজের চিন্তার ধারাকে প্রশ্ন করবেন –ভাঙবেন, গড়বেন। এই প্রস্তুতি টা আপনাকে একটু হলেও আলাদা করবে ,আর এই যুগের চাকুরীগুলো সেটাই খুজে। আর যদি সেটা নাও চান আমার মত ,তাহলে তো আরো ভাল- এই বিশাল কমিউনিটিই আপনার আসল প্রাপ্তি ,দিন শেষে এই প্রাপ্তি টাই খুউব সত্যি।
লেখক: সাবেক বিতার্কিক ও সাবেক সভাপতি, শামসুন নাহার হল ডিবেটিং ক্লাব এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন