কোন পথে বাংলাদেশের স্পর্ধিত তারুণ্য! ইতিহাস সৃষ্টির প্রতিটি পলেস্তারায় সেই তরুণ যুবকরাই জোগান দিয়েছিল। আজো বাংলাদেশের সব অভূতপূর্ব সৃষ্টিগুলোর জন্মই দেয় তরুণরা। ওয়াসফিয়ার হিমালয় জয় বা সেভেন সামিটর্স জয় আমাদের সাহসী করে, মোহিত করে স্বপ্নজালে। নারী ক্রিকেটারদের বীরত্ব আমাদের উজ্জীবিত করে ঘুরে দাঁড়াতে। একজন নারী সাংবাদিক নাদিরা যখন ঘুরে দাঁড়ায় মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমরা আশায় বুক বাঁধি। সময় বহিয়া যায়! কবির ভাষায় এই বহিয়া যাওয়া সময়ের হিসাব কে রাখে! বাংলাদেশ সৃষ্টি ও তার বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে এ দেশের তরুণ সমাজ।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ক্ষুদিরাম আর প্রীতিলতার কথা আমরা কে না জানি! কে না জানি ভাষা শহীদ রফিক, সালাম, বরকত, সফিউলদের কথা। আসাদের রক্তমাখা শার্টের সে অমর কবিতা আমাদের কি মনে করিয়ে দেয় না ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের কথা। একাত্তরের মহান মুক্তির সংগ্রামে কত হাজার, লাখো তরুণ আর যুবকের বীরত্বের কথা কে না জানে। বাংলার দামাল তারুণ্যই একদিন মুক্তির সূর্যপতাকা বহন করে এনেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের গণআন্দোলন কত শত আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে আমাদের তারুণ্য। চারদিকে তাকালেই আমরা সবচেয়ে বেশি দেখতে পাই তরুণদের। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই হলো তরুণ-তরুণী। কর্মক্ষম মানুষের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি অংশও তারা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পপুলেশন কাউন্সিলের গবেষণা মতে, তরুণ জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভারতে ৩৫ কোটি ৬০ লাখ, চীনে ২৬ কোটি ৯০ লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় ৬ কোটি ৭০ লাখ, যুক্তরাষ্ট্র ৬ কোটি ৫০ লাখ, পাকিস্তানে ৫ কোটি ৯০ লাখ এবং বাংলাদেশে রয়েছে ৪ কোটি ৭৬ লাখ। এই তরুণরাই বাংলাদেশের সব ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রেখে চলেছে।
ইতিহাস সৃষ্টির প্রতিটি পলেস্তারায় সেই তরুণ যুবকরাই জোগান দিয়েছিল। আজো বাংলাদেশের সব অভ‚তপূর্ব সৃষ্টিগুলোর জন্মই দেয় তরুণরা। ওয়াসফিয়ার হিমালয় জয় বা সেভেন সামিটর্স জয় আমাদের সাহসী করে, মোহিত করে স্বপ্নজালে। নারী ক্রিকেটারদের বীরত্ব আমাদের উজ্জীবিত করে ঘুরে দাঁড়াতে। একজন নারী সাংবাদিক নাদিরা যখন ঘুরে দাঁড়ায় মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমরা আশায় বুক বাঁধি। ৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জয় করেছে এ দেশের গর্ব আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী। লাখ লাখ তরুণ গার্মেন্টস শ্রমিক আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকাকে করেছে গতিশীল। প্রতিদিন হাজারো নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের জন্ম দিচ্ছে এ দেশের তরুণরা। আমরা প্রতিদিন একেকটি সকাল শুরু করি এ সব তরুণের নতুনত্বের আলোয়। কিন্তু এ সব সাফল্য আর আশার পাশাপাশি উঁকি দেয় আগামীর দুঃস্বপ্ন আর ভাবনা। কোন পথে যাবে বাংলার তারুণ্য।
সবুজ একটা মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ছেলেমেয়ে আর তাদের চিৎকার, আনন্দে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। সবাই মিলে বনভোজন আর গোল্লাছুট, সিনেমা দেখতে যাওয়া, দুষ্টুমি করে পরের গাছের ফল পেড়ে খাওয়া এগুলো তো তারুণ্যেরই চিহ্ন। সন্ধ্যায় সাহিত্য আড্ডা, কবিতার আসর, প্রভাত ফেরির ফুল, আমাদের ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গান এই তো আমাদের বাল্যকালের স্মৃতিকাতরতা। আমরা জীবনের সঞ্জিবনী শক্তি পাই এগুলো থেকে। সেদিন সকালবেলা বাসে উঠতেই বিশাল হট্টগোল লেগে গেল। অফিস যাত্রী দুই ব্যক্তির মধ্যে ঝগড়া আর তা প্রায় মারামারি পর্যন্ত গড়ানো উপক্রম। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলাম বাসের মাঝের সিটে একজন তরুণ বসে খুব আনমনে কানে হেড ফোনে গান শুনছেন। যেন জগৎ সংসারের কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। সেদিন আমার রিকশার সামনের রিকশার সঙ্গে এক মোটরসাইকেল যাত্রীর সংঘর্ষ লেগে গেল। বয়সে তরুণ (২০/২২) এক যুবক প্রায় ষাটোর্ধ্ব এক রিকশাওয়ালাকে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করল। মাদকাসক্তির কথা তো বলে শেষ করা যাবে না। তবে গ্রাম থেকে শহর সব জায়গায় মাদকের সর্বগ্রাসী ছোবল আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতার রাজনীতির লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে লাখো তরুণ। তাদের দিয়ে সমাজের সবচেয়ে কলুষিত কাজগুলো করানো হচ্ছে। দেশের অপরাধমূলক কাজগুলোর দিকে তাকালেও আমরা একটি ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই। হত্যা, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ নানান অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ছে তারা। কে এই নিদারুণ দুঃসময়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশের তরুণ যুবকদের পাশে।
প্রতিদিন দেশব্যাপী আমরা অসংখ্য তরুণ যুবদের দেখি আর হতাশ হতে হয়। এক অন্ধকারের দিকে যাত্রা করেছে লাখ লাখ তরুণ মাদকের যাত্রী হয়ে। লেখক ও গবেষক কাজী সুফিয়া আখতারের মতে, বাংলাদেশের তারুণ্য ইতিহাসের নতুন দিগন্ত তৈরি করেছিল একদিন। ৫০/৬০-এর দশকে এ দেশের তরুণরাই আমাদের সৃজনশীলতা, শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রধান বাহক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশ গঠনেও তরুণদের ছিল ইতিবাচক ভ‚মিকা। কিন্তু বর্তমান তরুণ সমাজের বড় অংশই ব্যক্তিগত লাভ, ভোগবাদে নিমজ্জিত। যদিও ব্যবসা, প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা, চাকরি ক্ষেত্রে তাদের অনেকের শক্ত অবস্থান রয়েছে কিন্তু তাদের বড় অংশই এ দেশের প্রতি মমত্ব আর আগের মতো হয়তো বোধ করে না। যে কারণে আগের মতো স্বেচ্ছাশ্রম আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তারুণ্য খুবই কম দেখা যায়। তারুণ্যের এই পশ্চাৎপদতার জন্য অবশ্যই আমাদের দেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিই দায়ী। তরুণদের রাজনীতি বিমুখতাও এ দেশের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।তরুণদের ওপর চালানো এক জনমত জরিপে দেখা যায় আমাদের দেশের প্রায় ৬০ ভাগ তরুণই প্রচলিত রাজনীতিকে পছন্দ করেন না। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির নগ্ন রূপকেই তারা দায়ী করেন। তাদের কাছে রাজনীতির সংজ্ঞায়নটাই হলো ক্ষমতার ভাগাভাগি আর সুবিধাবাদ কেন্দ্রীক দলীয় চর্চা। তারা প্রচলিত রাজনীতিকে এ দেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক বলে উত্থাপন করেন। তারা মনে করেন সুস্থ ধারার রাজনীতি এ দেশে চালু হওয়া জরুরি। যেখানে থাকবে সঠিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সব ক্ষেত্রে জবাবদিহি। একটি রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের প্রভাবে তরুণদের একটি অংশ জড়িয়ে পড়ছে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে। হলি আর্টিজানসহ বিভিন্ন ঘটনায় আমাদের মধ্যে এক ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের প্রগতিমুখিনতাকে ধ্বংস করার আরেকটি চক্রান্ত হলো এই জঙ্গিবাদী আগ্রাসন। এ থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করা জরুরি। কিন্তু এই সার্বিক দুরবস্থা থেকে এই তারুণ্যকে জাগাবে কে? বাংলাদেশে এক সময় সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়েরাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতেন।
সবচেয়ে মেধাবীরা সমাজে নানান ধরনের স্বেচ্ছাশ্রমের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতেন। একইভাবে সমাজও তাদের এই কাজের স্বীকৃতি দান করতেন। যে কারণে মেধাবীদের জায়গা সমাজের সর্বস্তরে ছিল। গান, কবিতা, আবৃত্তি, নাচ, খেলাধুলা, সাহিত্য আড্ডা, লিটলম্যাগ আন্দোলন, ছাত্ররাজনীতি সব কিছুদের তাদের ছিল প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। বামপন্থি রাজনীতির সামাজিক প্রভাবও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে আমাদের সমাজের প্রগতিবাদী চিন্তা ও সংস্কৃতির বিকাশও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের সব ক্ষেত্রে চরম দৈন্যতা লক্ষণীয়। না আছে খেলার মাঠ, না আছে পৃষ্ঠপোষক, না আছে সাহিত্য আড্ডা, না সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলন। প্রগতিশীল রাজনীতিও আগের মতো শক্তিশালী নয়। যে কারণে সমাজের সব ক্ষেত্রেই জেঁকে বসেছে সুবিধাবাদ, ভোগবাদ আর আত্মকেন্দ্রিকতা। আর এর সব কিছুকেই বাংলাদেশের তারুণ্য ধারণ করছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র ও সরকার প্রকৃত মেধাবীদের সঠিক মূল্যায়ন করছে না আর যার কারণে তারা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনার দেশ। এ দেশে জন্ম নিয়েছে কত জ্ঞানী, গুণী, রাজনীতিক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী। এখানে কৃষক জমিতে ফসল ফলায় আর বাউল আপন মনে গায়। এখানকার মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের মধ্যে অন্যতম। এখনো যৌথতার মধ্য দিয়ে পরিবার ও সমাজ এগিয়ে যাই। সেই দেশের তারুণ্য আজ নানানভাবে সংকটে নিমজ্জিত। কিন্তু পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জায়গায় আমরা এ সব তরুণের যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করছি কি? দিচ্ছি তাদের কাজের ও মেধার যথার্থ সম্মান?
আজ সময় এসেছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এই অপার সম্ভাবনাময় তরুণদের নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করার। এ ক্ষেত্রে তারুণ্যের চাহিদা ও স্বপ্নকে মূল্য দিতে হবে। তাদের কাজের সঠিক পরিবেশ দিতে হবে। তরুণদের জন্য দেশের নীতিনির্ধারণী জায়গা থেকে নিতে হবে সৃজনশীল উদ্যোগ। তাদের মেধা ও মননকে তারা নিজেদের মতো করে কাজে লাগাতে পারবে এবং তাদের স্বাধীন সত্তা নিয়ে তারা এগিয়ে যাবে এ ধরনের পরিবেশ নির্মাণ করাও জরুরি। মনে রাখা জরুরি এই স্পর্ধিত তারুণ্যই আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণ করবে। তারুণ্যের জয় হোক।
ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল : সম্পাদক, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন