শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। একটি জাতির ভবিষ্যত বিনির্মাণে শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয়। আর এই বিষয়টি মাথায় নিয়েই বর্তমান সরকার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে সারা বিশ্বে। বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছে নতুন বই। এই দিনটিতে সারা দেশে সাড়ম্বরে বই উৎসব পালিত হচ্ছে। এই নতুন বই শিক্ষার্থীদের জন্য এক অভিনব উপহার।
বাংলাদেশের মত দেশে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর মাঝে বই বিতরণ একটি যুগান্তকারী ও সাহসী পদক্ষেপ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ শুরু হয়। এ কার্যক্রম সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত মোট ২৬০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ২৯০টি বই বিতরণ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৬ হাজার ৮৯৫ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি বই বিতরণ করা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের এক কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১৮ কোটি ৭৩ লাখ ৮৫ হাজার ৯২১টি এবং প্রাথমিক স্তরে ২ (দুই) কোটি ১৭ লাখ ২১ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১০ কোটি ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ৪০৫টি বই বিতরণ করা হয়। এছাড়াও প্রাক-প্রাথমিকের ৩৪ লাখ ১১ হাজার ১৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৬৮ লাখ ২৩ হাজার ৬৪৮টি বই প্রাক-প্রাথমিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৫৮ হাজার ২৫৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য পাঁচটি ভাষায় এক লাখ ৪৯ হাজার ২৭৬টি বই বিতরণ হয়। আরও উল্লেখযোগ্য হলো ৯৬৩ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য ৮ হাজার ৪০৫টি ব্রেইল বই বিতরণ করা হয়।
বছরের প্রথম দিনে শিশুদের মাঝে বই বিতরণের ফলে সবার মাঝে একটা উৎসব বিরাজ করে। শিশুরা সারা বছর এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে। এই বই উৎসবের প্রধানতম সফল দিক হলো শিশুদের বিদ্যালয়মূখী করা সম্ভব হয়েছে। সকল শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। নতুল শ্রেণি, নতুন বই। এটি শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রেরণা ও উৎসাহ সৃষ্টি করে।
এই যুগান্তকারী কার্যক্রমের আগে বিভিন্ন মহল থেকে আমরা নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হতো বই বিতরণ নিয়ে। বছরের শুরু হলেও বই ঠিকমত পৌছাতে পারতো না শিশুদের কাছে বলে অভিযোগ ছিল সব মহল থেকেই। অভিভাবকদের অভিযোগও ছিল বিস্তর। নি¤œমানের বই, নি¤œমানের কাগজ, অস্পষ্ট ছাপা, ছাপার গুণগত মান, সব কিছু নিয়েই একধরণের সমন্বয়হীণতার বিষয়টি আলোচিত ছিল। সংশয়ে থাকতেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা। বিভিন্ন শ্রেণির বই বছরের পর বছর সময় মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রকাশকরা। বিনামূল্যে বিতরণের বই কালোবাজারে বিক্রি ছিল দেদারছে। বইয়ের সঙ্গে নোট বই কিনতে অভিভাবকদের বাধ্য করার মতো অনাকাঙ্খিত ঘটনার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বর্তমান সরকারের এই প্রশংসনীয় উদ্যোগটি সব নেতিবাচক সংবাদকে ছাপিয়ে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
বর্তমানে ঝকঝকে ছাপা রঙিন বই শিক্ষার্থীর হাতে দেয়া হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের বই সংগ্রহ করার দিনটি তাদের জন্য অনেক আকাঙ্খার। এটি শিশুদের বই পড়ার আনন্দ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা ও সদিচ্ছা থাকলে অনেক অন্তরায় দূর করা যায়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে সরকার। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণসহ শিক্ষা খাতে বাজেটের এক উেেল্লখযোগ্য বিনিয়োগ যে জাতির জন্য সত্যিকার অর্থেই লাভজনক তা বাস্তবতার নিরিখেই প্রমাণিত হয়েছে। দেশর সামগ্রিক শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই বিতরণ ও নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার পদক্ষেপ, শত চ্যালেঞ্জের মাঝেও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন বিশ্বে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
এখনো কিছু অভিযোগ পাওয়া যায়, সরকারি বিনামূল্যের বই এখনো বাজারে পাওয়া যায়। তবে এই হার খুবই নগণ্য। যতই নগণ্য হোক, বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। দেশে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ ও বিতরণকে ঘিরে যে একটি চক্র সবসময় সক্রিয় থাকে, তাদের মূলোৎপাটন করতে হবে। সরকারকে এক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে। বই উৎসব যেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, শিক্ষার মান বৃদ্ধিতেও আরো বেশি গুরুত দিতে হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে গুণগত মান বৃদ্ধি না হলে একটা পার্থক্য থেকেই যাবে। শিশুদের পাঠদান প্রক্রিয়া আরো অধিক কার্যকর ও আনন্দমূখর করলে নানমূখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে করা প্রয়োজন। হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে শিশুরা দৈনন্দিন পাঠ শেষ করতে পারে এমন কিছু উপকরণ তৈরী ও সরবরাহ করা প্রয়োজন। বর্তশানে ঝরে পড়ার হার খুব নগন্য, এটিকে শুণ্যের কোটায় আনা প্রয়োজন। বই উৎসব যেভাবে দেশের আনাচে কানাছে, তৃণমূলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, সেভাবে মানসম্মত শিক্ষার আন্দোলন পৌছাতে হবে দেশের প্রতিটি প্রান্তরে, প্রতিটি ঘরে ঘরে। বিশ্বায়নের যুগে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে যে চ্যালেঞ্জ সরকার নিয়েছে, সেটিকে আরো বেগবান করা সময়ের দাবি। পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষাকে আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে কোমলমতি শিশুদের মনে দেশপ্রেমের ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বীজটি বপন করতে পারলে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলা থেকে ছবিটি তুলেছেন রণবীর মিত্র বসুনীয়া
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন