গ্রামের সাড়ে ১৫ লাখ তরুণ-তরুণী কাজ খুঁজছেন। তাঁরা সপ্তাহে এক দিনও মজুরির বিনিময়ে কাজের সুযোগ পান না। কাজ না পেয়ে এসব তরুণ-তরুণী গ্রামে অনেকটা বেকার বসে আছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে এই চিত্র ওঠে এসেছে।
জরিপের ফলাফল বলছে, গ্রাম এলাকার ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ৯৩ জন তরুণ-তরুণী কাজ খুঁজেও পাননি। এর বাইরে কোনোভাবে কাজের মধ্যে নেই—এমন মানুষের সংখ্যা ৬২ লাখ ১৫ হাজার, যাঁদের বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী। তাঁরা কাজপ্রত্যাশী নন, আবার পড়াশোনা কিংবা প্রশিক্ষণও নেই। সব মিলিয়ে কাজের মধ্যে নেই গ্রামাঞ্চলের সাড়ে ৭৭ লাখ তরুণ-তরুণী।
গ্রামে কত মানুষ কাজ করেন, সেদিকে আসা যাক। সপ্তাহে অন্তত এক দিন কাজের সুযোগ পেয়েছেন ৪ কোটি ৭০ লাখ মানুষ। গ্রামেই তাঁদের কর্মসংস্থান হয়েছে। কেউবা খেতে-খামারে, কেউবা মিল-কারখানা, কেউ ছোটখাটো কাজ করছেন।
মজুরির বিনিময়ে কাজ না করলেও গৃহস্থালির কাজে দিনের বেশির ভাগ সময় পার করেন—এমন নারী-পুরুষের সংখ্যাও নেহাতই কম নয়। প্রায় ২ কোটি ৮ লাখ পল্লিবাসী গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত থাকেন। অবশ্য তাঁদের সিংহভাগই নারী। আর গ্রামের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সোয়া তিন কোটি। তাঁরা শুধুই পড়াশোনা করেন।
ছয় বছরের বেশি বয়সী পল্লিবাসীর মধ্যে কারা কাজের মধ্যে আছেন, কারা বেকার, কারা পড়াশোনা করেন—জরিপে সেই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের উন্নয়ন এমনভাবে হচ্ছে, যেখানে গ্রামের শ্রমশক্তি অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে। আবার বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে হচ্ছে না, এ কারণে অন্য খাতে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারছে না। এ ছাড়া কৃষি খাতে যান্ত্রিকীকরণের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে। ধানমাড়াই, রোপণ—সবই যন্ত্রের সাহায্যে হচ্ছে।
প্রথমবারের মতো কৃষি ও পল্লি পরিসংখ্যান জরিপ করেছে বিবিএস। ২০১৮ সালে জরিপটি করলেও তা সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। দেশের সব জেলার পল্লি এলাকার ৫৭ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিবিএস।
জরিপের সঙ্গে যুক্ত প্রকল্প পরিচালক আখতার হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জরিপটি করার সময় প্রশ্ন করেছিলাম, গত সাত দিনে কেউ কাজের খোঁজ করেছেন কি না। তখন যাঁরা বলেছেন, কাজ খুঁজেছেন কিন্তু পাননি, তাঁদেরই কাজ সন্ধানী হিসেবে ধরা হয়েছে।’ তিনি জানান, গ্রামের কর্মক্ষম কর্মজীবী মানুষের চিত্র তুলে ধরতেই এই জরিপ করা হয়েছে। জরিপটি নীতিনির্ধারকদের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সহায়ক হবে।
বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। আর প্রায় ৬৬ লাখ তরুণ-তরুণী পছন্দমতো কাজ পাচ্ছেন না। তাঁদের ছদ্মবেকার হিসেবে ধরা হয়।
বিবিএসের জরিপ বলছে, গ্রামে অর্ধেকের বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয় কৃষি খাতে। ৩০ শতাংশের মতো কাজের সুযোগ আসে দোকানপাট, পরিবহনসহ বিভিন্ন সেবা খাতে। কলকারখানায় বাকি কর্মসংস্থান হয়। আবার কৃষি খাতের কর্মসংস্থানের মধ্যে ৭০ শতাংশ নিজে ও পরিবারের সদস্যরাই করেন। এমন কর্মজীবীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ। বাকি ৭২ লাখ ৯১ হাজার প্রকৃত কৃষিশ্রমিক, যাঁরা মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন। একজন কৃষিশ্রমিকের দৈনিক গড় আয় ৩৮৬ টাকা। তাঁদের প্রতিদিন গড়ে পৌনে আট ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অবশ্য সপ্তাহে সব দিন নয়; পাঁচ দিন তাঁরা কাজ পান।
এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম সুপারিশ করেন, কৃষি খাতে প্রযুক্তির উৎকর্ষ বন্ধ করা যাবে না। তাই উৎপাদন ও সেবা খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে অন্য খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে।
বিবিএস বলছে, গ্রামে তিন কোটি পরিবার আছে, যার দুই-তৃতীয়াংশ কোনো না কোনোভাবে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। তবে কৃষি খাতই ওই সব পরিবারের প্রধান উৎস নয়। গ্রামের একটি পরিবার মাসে গড়ে আয় করে ১৬ হাজার ৮৯৩ টাকা। তবে এই আয়ের দুই-তৃতীয়াংশই আসে অকৃষি খাত থেকে। কৃষি খাত থেকে আসে ৩৮ শতাংশ বা সাড়ে ছয় হাজার টাকা।
গ্রামের কৃষক-খামারিরা ধান-চাল, শাকসবজি, হাঁস-মুরগি, ডিমসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে থাকেন। কিন্তু এসব পণ্য বাজারজাত করার ব্যবস্থা এখনো বেশ দুর্বল। হাটবাজারে গিয়ে বিক্রি করার সুযোগ কম। উৎপাদক ও বিক্রেতার মধ্যে ফড়িয়ারা ঢুকে পড়েন। বিবিএসের জরিপ বলছে, অর্ধেকের বেশি কৃষক পরিবারকে নিজের বাড়িতেই ধান, চালসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য বিক্রি করতে হয়। মাত্র ১৮ শতাংশ পরিবার স্থানীয় হাটবাজারে গিয়ে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারে। দুই-তৃতীয়াংশ কৃষক-খামারির নিজ বাড়ি থেকে অন্তত দুই কিলোমিটারের মধ্যে হাটবাজার নেই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন