সমাজ, দেশ-জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতির ক্ষেত্রে, কোনো কুসংস্কার-প্রথা কিংবা সামাজিক অবক্ষয় দূর করতে সেই দেশ-সমাজ-জাতির তরুণ সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য। আমরা আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ থেকে যতবার সফল হয়েছি ও বিজয়ের মুখ দেখেছি তার প্রত্যেক ক্ষেত্রে তরুণদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি এবং শক্তিশালী। ইভটিজিং, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাইসহ বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয়। এর প্রতিকারে আমাদের তরুণ সমাজের ভূমিকা যেমন আবশ্যকীয় তেমন জোরালো হওয়া উচিত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের তরুণ সমাজ কি এ নিয়ে সচেতন না জাগ্রত?
বর্তমান তরুণ সমাজের অধিকাংশ শুধু রাজনীতি থেকে দূরে নয় বরং রাজনীতি সম্পর্কে তাদের ধারণা খুবই নেতিবাচক। যা আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধ্বংসের ইঙ্গিত বহন করে। দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়- এই সময়ের তরুণদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণের এক সমীক্ষা করা হয় ১০০ তরুণদের ওপর যারা সবাই সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকের সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের বয়স ১৮-৩০ বছর। এ সমীক্ষায় দেখা যায় এখানে ৬২ জন তাদের প্রোফাইলে লিখেছে অর্থাৎ তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে এবং যারা খারাপ তারাই রাজনীতি করে। (অথচ রাজনীতি হচ্ছে সমাজ, দেশ, জনগণের মুক্তির ও অধিকার আদায়ের পন্থা, যা শুধু জনগণের কল্যাণের কথাই নয় বরং দেশের উন্নয়নের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় হবে) দেখা যাচ্ছে ২% রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, ২৮% নিরপেক্ষ এবং বাকি ৬% রাজনীতি সম্পর্কে মন্তব্য লিখেননি বা করেননি। এখানে দেখা যাচ্ছে, আমাদের তরুণ সমাজের রাজনৈতিক অবস্থা কত শোচনীয়। এমন চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের কী হবে! তা চিন্তার বিষয়। বেশ কিছুদিন আগে এটিএন বাংলা নিউজে মুন্নি সাহার উপস্থাপনায় একটি টকশোতে এক সময়ের দুর্দান্ত ছাত্রনেতা ও বর্তমান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমদ দর্শকদের শুধু ছাত্র রাজনীতির অতীত ইতিহাসই শোনাতে পেরেছেন; পারেননি এর বর্তমানকে ঢেলে সাজানোর মতো কোনো কথা দিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে কীভাবে রক্ষা করা যায় এমন কোনো পরিকল্পনার কথা জানাতে। যা আরো হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমাদের এই অবক্ষয়ের কারণ আছে। যে কারণগুলোর মধ্যে প্রধানতম হলো- (১) রাজনৈতিক প্রতিহিংসা: আমাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে জীবন দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে এবং চুনোপুঁটি রাজনৈতিক কর্মীদের অথচ রাঘব বোয়ালরা বহাল তবিয়তে বর্তমান (মূলত তাদের কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি)।
(২) চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি: চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির কারণে জনগণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ঘৃণা করেন এবং নিজের উত্তরসূরিদের যথাসম্ভব রাজনীতি থেকে দূরে রাখেন। (৩) দুর্নীতির মানসিকতা ও সুযোগ: রাজনীতি করার কারণে ব্যক্তি নিজেকে সবার চেয়ে বড় মনে করেন এবং দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন আর দল সে সুযোগ করে দেয়ার (দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার) ফলে তরুণরা রাজনীতির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। (৪) দলীয়করণ: বিভিন্ন চাকরি ও অন্য সুযোগ সুবিধা থেকে যখন একজন মেধাবী ছাত্র দলীয়করণের কারণে তার প্রাপ্য না পায় তখন যে রাজনীতিবিমুখ হয় এবং এ সম্পর্কে বাজে ধারণা পোষণ করে। (৫) অস্ত্রের ঝনঝনানি: তরুণ রাজনীতিদের অস্ত্রের ব্যবহারের কারণে জীবন নষ্ট ও অঙ্গহানি হচ্ছে। এতে নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন অনেক তরুণ রাজনীতি থেকে দূরে থাকছে। (৭) দুর্বল মানসিকতা: আমাদের অনেক রাজনীতি সচেতন তরুণ রাজনীতি থেকে শুধু দুর্বল মানসিকতার কারণে। তারা মনে করেন যারা একটু ক্ষমতা পেয়েছে তারাই সবকিছু করতে পারবে। তাই তারা মুখ বুজে সব সহ্য করে। যার ফলাফল ক্ষমতার অপব্যবহার এবং কলুষিত রাজনীতি। (৮) কথা ও কাজে মিল না থাকা: আমাদের প্রবীণ রাজনীতিবিদদের অধিকাংশ কথা ও কাজে মিল নেই। তারা প্রতিশ্রুতি দেন এক রকম আর কাজ করেন অন্য রকম। ফলে তরুণরা রাজনীতি সম্পর্কে হতাশ হতে বাধ্য হয়। (৯) মাদকতা: যে তরুণরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের অধিকাংশই আজ মাদকাসক্ত। তাই সুস্থ-রুচিশীল তরুণরা রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চান না। (১০) রাজনীতিকে আজ ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে। অনেক তরুণ মনে করে রাজনীতি শুধু নিজের জন্য (অথচ রাজনীতি দেশ ও জনগণের জন্য)। আর এ কারণেই তারা একে অপরের ওপর সশস্ত্র হামলা করতে পারে (একই আদর্শবাদী ও দলের হলেও)। যত কারণই থাক না কেন আমাদের সব বাধা বিপত্তিকে উতরিয়ে তরুণ সমাজের মধ্যে সুস্থ রাজনীতির চর্চা নিয়ে আসতে হবে এবং এর জন্য যা প্রয়োজন হবে তা হলো- (১) প্রবীণ রাজনীতিবিদদের দলীয়করণ ও আত্মীয়করণ বন্ধ করতে হবে। যাতে ভালো সৎ যোগ্য ও মেধাবী তরুণরা নেতৃত্বে আসতে পারে। (২) প্রত্যেক রাজনৈতিক দলে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। (৩) ছাত্র ও তরুণ সমাজকে মাদক ও অস্ত্র থেকে মুক্ত রাখতে হবে। (৪) আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ ও সমান অপরাধে সমান শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে এবং এ ক্ষেত্রে শুধু মুখের বুলি নয় কাজে পরিণত করতে হবে কিংবা শুধু দলীয় হওয়ার কারণে অবাধে অপরাধ করতে পারবে না। অপরাধকে ব্যক্তি বিবেচনায় নিতে হবে দলীয় বিবেচনায় নয়। (৫) সর্বোপরি আমাদের তরুণ সমাজকে সুস্থ রাজনীতির চর্চা করতে হবে এবং রাজনীতি যে জনগণের কল্যাণে তা উপলব্ধি করতে হবে। শেষ করব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার লাইন দিয়ে-
‘সত্য যে বড় কঠিন
কঠিনেরে ভালবাসিলাম
সে কখনও করে না বঞ্চনা।’
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন