একাদশ জাতীয় সংস্দ নির্বাচনকে সামনে রেখে সকল রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করবে। নির্বাচনী ইশতেহারে কী কী প্রতিশ্রুতি রাখা হয়, ভোটের সঙ্গে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনেকেই মনে করেন, এবারের ভোট হবে তারুণ্য নির্ভর, যে দল এই বৃহৎ অংশকে আকৃষ্ট করতে পারবে, শেষ বিকালে তারাই বিজয়ের আলো দেখতে পাবে।
এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ৪৪ লাখ। তন্মধ্যে তরুণ ভোটারের সংখ্যা ৪ কোটি ২০ লাখ। যাদের বয়স প্রায় ১৮-৩৫ বছরের মধ্যে। বিগত দশ বছরে অর্থাৎ ২০০৮ সালের পর নতুন ভোটার হয়েছে প্রায় ২ কোটি ২৫ লাখ। এবার প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন ১ কোটি ২১ লাখ ৭৭ হাজার ২১৪ জন।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে দেশ ও জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নতি নিশ্চিত করতে দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও শ্লোগান ধারণ করে নিরলসভাবে কাজ করবেন বলে যে ৩৩ দফা ঘোষণা করেন, সেখানে বেকার যুবশক্তিকে দেশের উৎপাদনশীল কর্মকান্ডে এবং বিদেশে কর্মসংস্থানে সক্ষম করতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, ঋণ-সহায়তা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
অন্যদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঘোষণা করে দিনবদলের সনদ। যেখানে তরুণদের মনোযোগ আকর্ষণের ওপর বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। দেশের তরুণ ও আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সর্বাত্মাক সহায়তা দিয়ে সফটওয়্যার শিল্প ও আইটি সার্ভিসের বিকাশ সাধন করা, ব্যাপক কর্মসংসস্থানের ব্যবস্থা করা, ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়।
একথা অনস্বীকার্য যে, তরুণ প্রজন্মের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক, আধুনিক, ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারলে দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি চিন্তুা করা সূদূর পরাহত। তারুণ্য নির্ভর ও যুববান্ধব ইশতেহার তৈরি করা হলে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী প্রায় ৪ কোটি ভোটারের মন জয় করা সম্ভব হবে। তাদের ইচ্ছা ও চাহিদার প্রতিফলন ঘটাতে পারলে অনেকটাই এগিয়ে যাবে।
আমাদের দেশে তরুণদের বিরাট একটা অংশ বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসেবে দেশে বেকারের সংখ্যা এখন ২৬ লাখ ৮০ হাজার। যদিও অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রকৃত কর্মহীন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার। বিশ্বব্যাংক তথ্য মতে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। সুতরাং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। তরুণ সমাজ পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দেখতে চায় ইশতেহারে।
ইন্টারনেটের বদৌলতে গোটা বিশ্ব হাতের মুঠোয়। সারাবিশ্বে যখন এগিয়ে চলছে, দ্রুত গতির ইন্টারনেট সেবা কিন্তু অনেক সহজলভ্য। বাংলাদেশে এখনো আমরা সে পর্যায়ে পৌছতে পারিনি, তাই ইন্টারনেট খরচ আরো কমানেরা ঘোষণা চায় তরুণ সমাজ। বিশ্বেও বিভিন্ন দেশের তরুণদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ই-কমার্সে বাংলাদেশ শীর্ষে অবস্থান করছে, এটিকে আরো ত্বরান্বিত করতে বহুমূখী ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং গণজমায়েতের স্থানে ফ্রি ওয়াই-ফাইয়ের ব্যবস্থা করার বিষয়টিও অর্ন্তভূক্তি সময়ের দাবি।
তরুণ সমাজের একটি অংশ মাদকে নিজেদের জড়িত করছে। মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ ও তরুণ সমাজকে এই সামাজিক সমস্যা থেকে দুরে রাখার জন্য নানা কার্যক্রম গ্রহণ বিষয়ে ইশতেহারে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা প্রয়োজন। বয়স্ক বেকার তরুন সমাজের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনামূলক প্যাকেজ থাকা প্রয়োজন।
প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষিত বেকার তরুণদের অগ্রযাত্রা আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত। এখন প্রয়োজন সঠিক পরিচর্যা ও নতুন নতুন প্রযুক্তর সঙ্গে আমাদের বিপুল জনশক্তির বেকার সমাজকে মেলবন্ধন ঘটানো। এটি সঠিকভাবে করতে পারলে আমাদের অর্থনীতিকে বড় অবদান রাখতে পারে এই তরুণ সমাজ।
আমাদের দেশে তরুণ উদ্যোক্তার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অনেকে উদ্যোমী হয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করছে। নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। কিন্তু ওদেও অতিক্রম করতে হচ্ছে নানা প্রতিকূলতা। তরুণ উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে তুলতে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, উদ্যোক্তাদের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে তাঁদের ব্যবসায়িক সমস্ত কার্যাদি সম্পন্ন করার ব্যবস্থা রাখা। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী অঙ্গীকারে এই বিষয়টির অর্ন্তভূক্তি জরুরি।
শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক, প্রয়োজন কর্মমূখী শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন কারিগরী শিক্ষা প্রচলন ও গ্রহণ করা সময়ের দাবি। কারিগরী শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করাও জরুরি। নৈতিক শিক্ষার বিষয়টিকেও জোর দিতে হবে। বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় ভ্যাট আরোপ না করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য যানবাহন সহায়তা প্রদান, যাতে শিক্ষার্থীরা নির্বিঘেœ যাতায়াত করতে পারে।
ভবিষ্যত রাজনীতি প্রজন্ম তৈরীর লক্ষ্যে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু ও নিয়মিতকরণ প্রয়োজন। এখন থেকেই স্বচ্ছ রাজনীতির পাঠ নিতে পারবে মেধাবীরা। রাজনীতিতে মেধাবী যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করতে পারলে একটি সুন্দর সমাজ তৈরী হবে। সামাজিক পরিবর্তন বিষয়ক কাজে যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের সামগ্রিক উন্নতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো সেশন জট থাকবেনা এমন অঙ্গীকার রাখা। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়টিও থাকা বাঞ্চণীয়। সরকারি চাকরিতে আবেদনের ফি চাকরি প্রার্থীদের জন্য একটি বোঝা, এটি বন্ধ করারও অঙ্গীকার রাখা। বেসরকারি চাকরি নীতিমালা প্রণয়ন এবং সুবিধাদি বৃদ্ধিকরণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে সরকারি চাকরির উপর চাপ কমবে।
ত্রিশোর্ধ্ব শিক্ষিত বেকারের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইন্টার্নশিপ ব্যবস্থা রাখা এবং সন্তোষজনক হলে চাকরিতে স্থায়ী করা। বেকার সমস্যা সমাধানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুই বছরের মধ্যে সব ধরণের নিয়োগ সম্পন্ন করার বিষয়টিও অর্ন্তভূক্ত প্রয়োজন।
টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে যুব সমাজকে কাজে লাগতে হবে। যুবসমাজের বেকার সমস্যঅ সমাধান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, জেন্ডার বৈষম্য দূরীকরণকে আমলে নিতে হবে। তরুণ সমাজ এমনই একটি তারুণ্যবান্ধব ইশতেহার চায়, যা বদলে দিতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক চেহারা।
সফিউল আযম: এডিটর ইন চিফ, ইয়ুথ জার্নাল
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন