একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মানেই অনেককিছু। প্রজেক্টর, সাউন্ড বক্স, ল্যাপটপ, মাইক্রোফোন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুত্ সংযোগ। এর একটি উপকরণও যদি না থাকে তাহলে কোনোভাবেই একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরি করা সম্ভব না। কিন্তু দেশের অনেক স্কুলেই বিদ্যুত্ সংযোগ নেই। তাহলে তারা কি কোনোভাবে এই ডিজিটাল শিক্ষার আওতায় আসতে পারবে না? আবার বর্ষাকালে দেশের অনেক স্কুল বন্যায় তলিয়ে যায়। তখন মাসের পর মাস পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায় বন্যাঞ্চলের কিশোর-কিশোরীদের। তলিয়ে যাওয়া স্কুল আর ক্লাসরুম আবার আগের মতো নির্মাণ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় তাদের। তবে আজ আপনাদের এমন একটি সংগঠনের কথা জানাবো, যারা এসব প্রতিকূলতা জয় করেছে।
একটি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সারাদেশের যেকোনো স্থানে, যেকোনো পরিস্থিতিতে, যেকোনো সময়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে সক্ষম একদল তরুণ। এই ব্যাগটিকে একটি আলোর ফ্যাক্টরি বললেও ভুল হবে না। কারণ একটি ব্যাগেই ঢুকে আছে আস্ত একটি স্কুল! কি নেই এই ব্যাগে! প্রজেক্টর, সাউন্ড বক্স, ল্যাপটপ, মাইক্রোফোন সব! আর বিদ্যুত্ সংযোগেরও প্রয়োজন হয় না। শুধু ব্যাগ থেকে বের করে ঠিকভাবে সেটিং করলেই হলো। এটার মাধ্যমে যেমন আমেরিকায় বসে যে কেউ যেকোনো জায়গার শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন তেমনই স্কুলে উপস্থিত থেকে পড়ুয়াদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম বানিয়ে পড়াতে পারবেন খুব সহজেই।
যেভাবে প্রজেক্টটি কাজে লাগানো যাবে
ওয়ালী উল্লাহ, মারুফ, শোয়েব, মোমেল ও তৃপ্তি মূলত এই কার্যক্রমের মূলহোতা। সমন্বিত এই তরুণদের সংগঠন ‘লাইট অব হোপ’। ২০১৪ সালে মূলত লাইট অব হোপের যাত্রা শুরু। কিভাবে শুরু সেই গল্প শুনতে গিয়েছিলাম প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী ওয়ালী উল্লাহর কাছে। তিনি বলেন, ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) থেকে ইইই বিভাগ থেকে অনার্স পাস করে জার্মানিতে এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্টে ডিএএডি বৃত্তি নিয়ে মাস্টার্স করতে গিয়েছিলাম। ২০১৩ সালের ঘটনা এটি। সেই বছরই ডেল আয়োজিত অ্যাডুকেশন চ্যালেঞ্জ নামে একটি প্রতিযোগিতা হয় সেখানে। আমি সেই প্রতিযোগিতায় একটি প্রজেক্ট উপস্থাপন করি। প্রজেক্টের বিষয়টি ছিল, কিভাবে বিদ্যুত্হীন স্কুলে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করা যায়। সেখানে সারাবিশ্বের শিক্ষার্থীদের পাঠানো ৮১৬টি প্রজেক্টের মাঝে আমার প্রজেক্ট তৃতীয় স্থান লাভ করে। পুরস্কার জিতে অনেক খুশি হওয়ার পাশাপাশি একটু ভাবনা-চিন্তাও শুরু হলো। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেটা হয়, পুরস্কার জিতে প্রজেক্টের আর তেমন অগ্রগতি দেখা যায় না। আমি সবসময় ভাবতাম কিভাবে এই প্রজেক্টটা বাংলাদেশে কাজে লাগানো যায়।
ডেল অ্যাডুকেশন চ্যালেঞ্জে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া আড়াই হাজার ডলার দিয়ে দেশে এসে ২০১৪ সালে মাঠে নেমে পড়েন তিনি। ওই বছরের জুনে চট্টগ্রামের স্বপ্ননগর স্কুল ও কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার পটুয়াভাঙ্গা গ্রামের পরশমণি শিক্ষা একাডেমিতে তারা সোলার প্যানেল স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপটি সম্পন্ন করেন। এর কয়েকদিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে স্কুলে হস্তান্তর করেন ল্যাপটপ, প্রোজেক্টরসহ ই-শিক্ষার সব উপকরণ। লাইট অব হোপ শুধু শিক্ষা উপকরণই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়নি, সেখানকার শিক্ষকদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছে।
দীর্ঘ চিন্তার হঠাত্ বাস্তবায়ন!
মাল্টিমিডিয়া ক্লাস সেট ব্যাগ বানানোর বিষয়টি বাস্তবায়ন হয় ২০১৬ সালে। লাইট অব হোপের কর্মকর্তারা বলেন, সেসময় সিসিমপুরের একটা প্রজেক্ট শুরু করলো। তারা দেশের বিভিন্ন স্কুলে যাবে, সেখানে ছেলেমেয়েদের তাদের সচেতনামূলক এপিসোডগুলো দেখাবে। কিন্তু তারা কিভাবে দেখাবে বা কিভাবে সারাদেশের স্কুলগুলোতে যাবে। কারণ দেশের অনেক স্কুল আছে যেখানে সরু রাস্তা। সেসব রাস্তায় ভ্যানে করে প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, সাউন্ড বক্স নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। তো ওরা আমাদের কাছে এলো কিভাবে কি করা যায় জানার জন্য। আমরা তখন একটা সোলার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম বানাচ্ছিলাম, যেটা স্কুলে স্থায়ীভাবে বসে যাবে। সিসিমপুর আমাদের সাথে যোগাযোগ করার পর আমরা ভাবতে থাকলাম, কিভাবে টোটাল একটা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমকে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলা যায়! তাতে যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় একটা ক্লাসরুম করা যায়। তো আমরা সেই ডিজাইন করলাম। কোয়ালিটি ঠিক করে সবকিছুর সাইজ কমিয়ে ফেললাম।
সবকিছুকে একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলার আইয়াডিয়াটা ছিল ওয়ালী উল্লাহর। এই আইডিয়াটা মূলত ব্র্যাক থেকে পেয়েছেন। ২০০৯ সালে যখন দেশে আইলা হয় তখন তিনি ব্র্যাকে চাকরি করতেন। তখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রজেক্টরে সচেতনামূলক নাটিকা বা গান দেখানোর মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করা মূলত তার কাজ ছিল। প্রজেক্টর থেকে শুরু করে জেনারেটরসহ সব উপকরণ মিলে ৮০ কেজির একটি বহর নিয়ে যেতে হতো, তখনই তিনি ভাবেন কিভাবে এগুলোকে একত্র করা যায়। কিন্তু সেসময় এটা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত এই কাজটি বাস্তবায়ন করেছেন তাইজুল ইসলাম অনিক। ওয়ালী উল্লাহ বলেন, ‘ক্রেডিট আসলে ওরই বেশি। আমি জিনিসটা চিন্তা করেছি শুধু, আর সে এটা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে।’ তাইজুল ইসলাম অনিক বলেন, ‘এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ পুরো একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাস, সেটা একটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকানো কম খাটুনির ব্যাপার না। এতে করে সবকিছু ছোট হয়ে এসেছে, আর ল্যাপটপের জায়গায় বসেছে আমাদের নিজস্ব একটি প্রযুক্তি।’ সিসিমপুরের ওই প্রজেক্টের জন্য তারা তখন ১২টি স্ফুটনিক ব্যাগ বানালেও বর্তমানে তাদের বানানো ব্যাগের সংখ্যা ২৭টি। ৬ কেজি ওজনের প্রতিটি স্ফুটনিক নিয়ে টানা ৬ ঘণ্টা ক্লাস নেওয়া যায়, আর চার্জ শেষ হলেই আছে সৌরবিদ্যুত্।
খরচ মাত্র ৬০ ওয়াট!
ওয়ালী উল্লাহ বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় ৯ হাজার প্রাথমিক স্কুলে বিদ্যুত্ সংযোগ নেই। এসব স্কুলে এটা প্রয়োগ করা খুবই ভালো। সরকারও সব স্কুলকে ডিজিটাল করতে চাচ্ছে। কিন্তু যে স্কুলগুলোতে বিদ্যুত্ নেই সেগুলোতে করতে পারছে না। আমরা এই কাজটা করতে পারবো। একটি ৬০ ওয়াট বাল্ব জ্বলতে যে পরিমাণ বিদ্যুত্ খরচ হয় সেই পরিমাণ বিদ্যুতেই একটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করে দেবো। আর এতে খরচ হবে ২ লাখ টাকার মতো।
‘কিডস টাইমস’
প্রতিষ্ঠানটি শুধু মাল্টিমিডিয়া ক্লাসসেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্কুল শেষে শিশুদের আনন্দময় ও সৃজনশীল উপায়ে শিক্ষাদান করতে ২০১৭ সালের মে মাসে চালু করেছে ‘কিডস টাইমস’। ঢাকার ধানমণ্ডি, গুলশান-১, উত্তরা, বনানী, মিরপুর ডিওএইচএস এবং চট্টগ্রাম শাখায় তাদের প্রায় ২৫০ ছাত্রছাত্রী ও ১৪ জন শিক্ষক আছেন। ‘কিডস টাইমস’-এর ধানমণ্ডি শাখায় গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের আশেপাশে ছড়ানো রঙ-তুলিসহ আঁকার অনেক উপকরণ। তারা মজার মজার ছবি আঁকছে। যেমন একটি শিশু টোকাইয়ের ছবি এঁকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে তার খাঁড়া চুল বানিয়েছে। আরেকজনের সজারুর রঙটি লাল। পিঠের খাঁড়া কাঁটাগুলো দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে তৈরি। পায়ের মোজায় কাগজ সেঁটে শুয়োপোকা বানিয়েছে অন্যজন। আইসক্রিমের কাঠি দিয়ে বিমান বানিয়েছে এক শিশু। একজন নিজে গল্প লিখেছে, সেটির চরিত্র অনুসারে পাপেট বানিয়েছে। শিশুরা সবাই ৪ থেকে ১০ বছরের।
ওয়ালী উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের স্কুলের কোর্সগুলো করে শিশুরা নিজেরাই বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় গল্প লিখছে। আমরা বাংলা ভাষায় গল্প লেখার জন্য তাদের উত্সাহিত করছি। পরে সেগুলো বই আকারে প্রকাশিত হচ্ছে। বইগুলোর ছবিও তাদের আঁকা। বইগুলো আমরা কিডস টাইমসের ওয়েবসাইটে ই-বুক আকারে দিচ্ছি। সেখান থেকে যে কেউ বইগুলো বিনামূল্যে ডাউনলোড করে পড়তে পারেন। আমরা সেটির নাম দিয়েছি ‘শিশুদের লেখা গল্প’। সেখানে সেই শিশুর ছবি, পরিচিতি, গল্পটি আছে। তাদের সৌজন্য সংখ্যাও দেওয়া হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘ভবিষ্যত্ পৃথিবীতে স্কুলের লেখাপড়ার খুব বেশি গুরুত্ব থাকবে না। বরং সৃজনশীলতা, সমস্যার সমাধান ও মানবীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশই সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে। প্রচলিত স্কুলগুলোতে এই বিষয়গুলোর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না বলে আমরা এই কার্যক্রম শুরু করেছি। এই কোর্সগুলোর মাধ্যমে অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের সৃজনশীল দক্ষতা বাড়াতে পারেন।’
আরেক উদ্যোগ ‘পড়ুয়া’
সারাদেশের অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাগার বানিয়েছে এই সংগঠনটি। মাত্র ৮ হাজার টাকার বিনিময়ে তারা এই কাজটি করে থাকেন। তারা পাঠাগারগুলোর বইয়ের তালিকায় রেখেছেন দেশের বিভিন্ন প্রকাশনীর বাছাই করা শিশুতোষ বইগুলো। তাদের এই প্রজেক্টের নাম ‘পড়ুয়া’। যেকোনো স্কুল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের এই প্রজেক্টের আওতায় আসতে পারে। লাইব্রেরি পরিচালনায় যদি স্কুল সফল হয় তাহলে পরবর্তীতে সাইন্সল্যাব করে দেওয়া হয়। সাইন্সল্যাবের যথাযথ ব্যবহার করলে ওই স্কুলের শিক্ষকদের ট্রেনিং করানো হয় সেইসাথে ক্লাসরুমগুলোকে মাল্টিমিডিয়ার আওতায় নিয়ে আসেন তারা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন