ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় অনার্স শেষ করে নজরুল ইসলাম দেলোয়ার চাকরির কথা ভাবেননি। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন কৃষিকে। এ জন্য থিতু হয়েছেন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার আন্ডারচরে। অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতি বিভাগে মাস্টার্সও করছেন। প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার নোয়াখালী থেকে এসে ক্লাস শেষ করে সুবিধাজনক দিনে আবার গ্রামে ফিরে যান তিনি। ছয় একর জমিতে নজরুল শুরু করেছেন মাছের খামার। খামারের পাড়ে চাষ করছেন নানা রকম সবজি। পাশেই গড়ে তুলেছেন বিশাল মুরগির খামার। একটি গরুর খামার তৈরির পরিকল্পনাও করেছেন তিনি। সে লক্ষ্যে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। মাছের খামারের পাশে রোপণ করেছেন আড়াই হাজার নানা প্রজাতির গাছ।
দুবাই প্রবাসী বাবা মোরশেদ আলমের জমিতে ১০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে চলতি বছর কৃষি কাজ শুরু করেন নজরুল।
তিনি স্বপ্ন দেখেছেন গোটা এলাকাকে জাগিয়ে তোলার; তরুণ মনের সবটুকু স্বপ্ন-সাহস প্রয়োগ করেছেন এখানে। একদিন তিনি প্রত্যন্ত এ অঞ্চলে কৃষিতে বিপ্লব ঘটাবেন- এই তার স্বপ্ন। তাতে এগিয়ে যাবে এ অঞ্চল; কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে বহু মানুষ। নজরুল বলেন, 'কৃষিকাজ মানে শুধুই গ্রাম্য মামুলি কাজ- এ ধারণা বদলে দিতে চাই। চাই পুরোপুরি আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন ও বিপণন।
নজরুলের মতো তরুণদের হাত ধরেই দেশে শুরু হচ্ছে কৃষিতে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন। তার মতো শিক্ষিত তরুণদের অংশগ্রহণে পাল্টে যাচ্ছে পুরো বাংলাদেশের কৃষিচিত্র। চাকরির নির্ধারিত জগৎ ছেড়ে দিয়ে মাটি ও কৃষিভিত্তিক কাজে অংশ নিয়ে নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই রচনা করছেন তারা।
এমন আরও তিন শিক্ষিত তরুণ কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় গড়ে তুলেছেন বিষমুক্ত খামার 'গ্রিনারি এগ্রো'। গ্রামীণ মানুষের দুয়ারে দুয়ারে কৃষিতথ্য ও জৈব সার পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে অভাবনীয় এক উদ্যোগ নিয়েছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি গ্রামের এক দল তরুণ শিক্ষিত কৃষি উদ্যোক্তা। আরেক তরুণ রাজশাহীর বাঘা উপজেলার অমলপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলম হোসেন এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ফিলোসফিতে স্নাতক ও মাস্টার্স শেষ করে বাবার সঙ্গেই পারিবারিক কৃষিকাজ শুরু করেছেন। ঝিনাইদহের শৈলকূপার দেলোয়ার হোসেন ইংরেজি সাহিত্যে ২০১৪ সালে মাস্টার্স পাস করে ৬০ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তোলেন টার্কি ফার্ম। নৃবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক রুহুল চৌধুরী, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের রিজওয়ানসহ ১৪ তরুণ-তরুণী মিলে সিলেট শহরের বাদাঘাট এলাকায় মাছ চাষ, দুগ্ধ খামার ও পোলট্র্রি খামার গড়ে তুলেছেন।
একইভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে সোহেল রানা নওগাঁর প্রত্যন্ত এলাকা সাপাহারে 'রূপগ্রাম এগ্রো ফার্ম' নামে গড়ে তুলেছেন একটি সমন্বিত কৃষি খামার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে প্রথম বিভাগ পেয়ে পড়াশোনা শেষ করে দেলোয়ার জাহান মানিকগঞ্জে দেড় একর জায়গায় কৃষি খামার গড়েছেন। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে সাত তরুণ গড়ে তুলেছেন এগ্রো ফার্ম। চুয়াডাঙ্গা সদরের তরুণ আলিমুজ্জামান ও ফিরোজুল হক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ১০ বিঘা জমিতে কৃষি খামার করেছেন। ঢাকা কলেজে মাস্টার্স পড়ার পাশাপাশি নিজের এলাকা রাজবাড়ীতে কৃষি খামার গড়ে তুলেছেন আমিরুল ইসলাম আমির। রাজধানীর বাড্ডাতে টার্কি খামার করে সাড়া ফেলেছেন প্রকৌশলী শাহীন হাওলাদার ও তরুণ উদ্যোক্তা মিরাজ হোসেন।
উৎপাদন ও বাণিজ্যের আধুনিক ধারা বুঝেই শিক্ষিত তরুণরা কৃষিতে যুক্ত হচ্ছেন। একটি সমন্বিত কৃষি খামারকে তারা অনায়াসেই লাভজনক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ভাবতে পারছেন। দেশের প্রায় সব এলাকাতেই কৃষির নতুন নতুন খাতে আধুনিক প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে এগিয়ে আসছেন তারা। বিশ্নেষকরা মনে করেন, কৃষিতে নানা ধরনের সহায়তা বাড়ছে। ঋণের সুযোগ বেড়েছে, কৃষি সহায়তা বেড়েছে; শিক্ষিত তরুণরা তাদের কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র খুঁজতে গিয়ে কৃষিতে আত্মনিয়োগ করে সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের কৃষি নতুন যুগে প্রবেশ করবে।
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) অর্থায়নে কৃষির বিভিন্ন খাতে প্রায় ২২ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষি উদ্যোগকে অর্থায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন ধরনের ফসল ও পণ্য উৎপাদনে যুক্ত হয়েছেন প্রায় তিন লাখ উদ্যোক্তা। প্রচলিত ধারার বাইরে বিকল্প খামারের দিকেও ঝুঁকছেন দেশের তরুণরা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও গড়ে উঠছে কচ্ছপ, উট, উটপাখি, টার্কি, কুমির, ব্যাঙ এমনকি সাপের খামারও। বিশ্বে নানা ধরনের খামারের যে অপার সম্ভাবনার দ্বার রয়েছে, বাংলাদেশেও তা খুলতে শুরু করেছে। নতুন রূপ পাচ্ছে কৃষি। শিক্ষিত তরুণরা নানা সূত্র থেকে কৃষিবিষয়ক তথ্য জোগাড় করতে পারেন। তার কাছে মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কৃষির খবর আছে। তিনি সহজেই নতুন কিছু গ্রহণ ও প্রচলন করতে পারেন। এ কারণেই এখন বাংলাদেশের তরুণদের হাত দিয়ে এখানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশেষ ধরনের কমলা ম্যান্ডরিনের চাষও হচ্ছে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলে যাচ্ছে। আর তরুণরা সেই বিষয়টি মাথায় রেখে নতুন ফসল ও ফলের উৎপাদনে যাচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, এখন কৃষিকাজে জড়িতদের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী। এর ফলে কৃষিকাজে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বলে মনে করছেন কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ। তিনি বলেন, কৃষি এখন অর্থ আয়ের খাতে পরিণত হচ্ছে, যা তরুণদের আকৃষ্ট করছে। কৃষিকাজের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ আশা জাগানোর মতো। এটা কৃষির একটি ঐতিহাসিক বাঁক পরিবর্তন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব মতে, সবজি চাষের জমি বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে প্রথম, আর উৎপাদন বৃদ্ধির হারে তৃতীয়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সবজি উৎপাদন বেড়েছে পাঁচ গুণ। ফল উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) মৎস্য সম্পদের অবদান এখন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশের জিডিপিতে খাতটি অবদান তো রাখছেই, পাশাপাশি বিশ্বেও একটি ভালো অবস্থানে নিজেকে নিয়ে গেছে বাংলাদেশ। মৎস্য সম্পদ (মাছ, আবরণযুক্ত জলজ প্রাণী ও শামুক) উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অষ্টম স্থানে। বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ উৎপাদনের পরিমাণ ৪১ লাখ টন। আর এসব সাফল্যের ধারায় তরুণদের অংশগ্রহণ নতুন মাত্রা যোগ করছে বলে মনে করেন বিশ্নেষকরা।
কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ বলেন, দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষিত তরুণরা এ উদ্যোগগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কৃষিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পারেন। কৃষি মানে এখন শুধু পৈতৃক পেশা ধরে রেখে কোনো রকমে টিকে থাকা নয়। কৃষি এখন সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক একটি উদ্যোগ। এ উদ্যোগের সঙ্গে এ দেশের তরুণ-তরুণী ও বেকার যুবকরা যুক্ত হয়ে কৃষির সংজ্ঞাকেও পাল্টে দিয়েছেন। তাদের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। তরুণরা বুঝতে পেরেছেন, কৃষি একটি অর্থকরী খাত। তাই তারা কর্মসংস্থানের জন্য এ খাতকে বেছে নিয়ে উদ্ভাবনী জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছেন।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (গবেষণা) কমলা রঞ্জন দাশ বলেন, সনাতন পদ্ধতিকে বদলে আধুনিক পদ্ধতির কৃষিকে এগিয়ে নিতে শিক্ষিত তরুণরা এখন কাণ্ডারির ভূমিকায়। তাই আগ্রহী তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতে প্রকল্প এবং বিনামূল্যে বীজ ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা হয়।
তরুণদের বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ দিলে দেশের কৃষি খাতের রূপান্তর আরও দ্রুত হবে বলে মনে করেন খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের (খানি) সভাপতি ও ইরি বাংলাদেশের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. জয়নুল আবেদিন। সমকাল
মন্তব্য করতে লগইন করুন অথবা নিবন্ধন করুন